দেশের গল্প, বেদনার দিনলিপি
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:২৪:৩৫,অপরাহ্ন ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ৭৪৬ বার পঠিত
“সব পাখিই নীড়ে ফিরে” সাইদুল ইসলাম অপু
প্রবাসী হয়েছি আজ প্রায় ৮ বছর, যে দিন প্রথম প্রবাসে আসি সে দিন একে একে সবার কাছে থেকে বিদায় নিলাম। আমার দাদু আমাকে কিছুটা আড়ালে ডেকে নিয়ে হাতের মুঠোয় কিছু টাকা গুঁজে দিলেন, আমি বললাম, দাদু আমার তো টাকার দরকার নেই আমি টাকা দিয়ে কি করবো? তিনি বললেন বিমানে চকলেট কিনে খাবে। কয়েক মাস পর দাদু অসুস্থ হয়ে পড়লেন, দাদুর খবর জানতে আমি দেশে আমার চাচীআম্মাকে ফোন দিলাম, তিনি কথা বলা অবস্থায় হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর আমি হ্যালো হ্যালো বলছি কোন সাড়া শব্দ নেই, অল্পক্ষণ পর চাচীআম্মা ফোনের ঐপাশ থেকে জানালেন দাদু আর নেই।
দিনটি ছিল ২৮ শে ফেব্রুয়ারি ২০১০ ইং,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আমার মতো কয়েকশ যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ বিমান যখন উড়াল দেয়ার জন্য রানওয়েতে গেল তখন বাংলাদেশে ভোর, আব্বাকে ফোন দিলাম, তিনি জানালেন ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে হাত তুলে আমার জন্য দোয়া করছেন, প্রবাসী মাত্রই বুঝবেন ঐসময়টা কেমন লাগে, আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, শুধু বললাম আবার দেখা হবে, ভালো থেকো, এরপর একে একে কেটে গেল কয়েকটি বছর।
৩ মার্চ ২০১৩ সাল, চোঁখে ঘুম নেই, বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করছি, এতো যন্ত্রণা কোনদিন লাগেনি। ঐসময় দেশ থেকে ফোন আসল বন্ধু সাজ্জাদের কাছে থেকে, জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি? বললাম ভালো নেই, অশান্তি লাগতেছে, সে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বলে দিল অপু, মামা আর নেই। আমি খুব কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম কোন মামা? সে উত্তর দিল তোর আব্বা। হতবিহ্বল এই আমি তখন দিকশূন্য, এত বড় দুসংবাদ আমার জীবনকে পাল্টে দিলও, আমার চিন্তা ভাবনার জগতে তোলপাড় শুরু হলো, উড়ন্ত আমি ধপাস করে যেন মাটিতে পড়ে গেলাম,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
প্রবাসে একাকি আমি যখন সবকিছু সামলে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত তখন আরেকটি খারাপ সংবাদ ধেঁয়ে আসলো আমার দিকে, আব্বার চলে যাওয়ার মাত্র এগার দিনের মাথায় ১৪ মার্চ ২০১৩ ইং আমার নানীও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। অসুস্থ হওয়ার আগে যখন উনার সাথে কথা হয়েছিল তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দেশে কবে আসবে? তোমার জন্য টুনি আনবো, আমিও রসিকথা করে বলেছিলাম, তুমি থাকতে আর টুনির দরকার কি? মনে করো তুমিই আমার টুনি, আমার কথা শুনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী তো হাসতে হাসতে শেষ,,,,,,,,,,,,,,,,
মান্নান চাচা (আব্বার চাচাতো ভাই), আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। দেশ ত্যাগের দিন বিদায় জানাতে বিমান বন্দর পর্যন্ত এসেছিলেন। ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর সকালে ঘর থেকে বের হলাম কাজের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যেই দেশ থেকে বড় বোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম চাচা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোক পাড়ি দিয়েছেন। সপ্তাহ খানেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের খবরাখবর নিতে অনেকক্ষন কথা বলেছিলাম চাচার সাথে, উনার মনের আনন্দ হাজার মাইল দূর থেকে আমি টের পাচ্ছিলাম। কথার একপর্যায়ে বললেন, আমাকে মিস করছেন। বললাম চাচা, আমিও যে খুব মিস করতেছি,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আমার ছোট চাচা, সিলেটে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাবার আগে শেষ বারের মতো আমার সাথে কোলাকুলি করেনিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়াও করলেন। তারপর সবকিছু ভালো মতোই চলছিল, কিন্তু কখন যে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন টেরই পেলেন না। একদিন ফোনে দুজনে খুব কান্নাকাটি করলাম, তারপর বললাম শীঘ্রই দেখা হবে চাচা। কিন্তু তিনি আর আমার জন্য অপেক্ষা করলেন না, মাস তিনেক আগে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অপারে চলে গেছেন,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার, আমাদের হেলাল চাচা (আব্বার চাচাতো ভাই) একেবারে অস্বাভাবিক ভাবে বয়স ৫০ হওয়ার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন, উনার ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগতো, অনেক বড় মনের অধিকারী ছিলেন। উনার মৃত্যুর পর উনার ভাগ্নে রিফাত লন্ডন থেকে আমাকে ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠালো, “অপু ভাই, তোমার মনে আছে মামা তোমাকে কতটা আদর করতেন?” ঐ দিন আম্মা আমাকে জানালেন উনি নাকি আম্মাকে বলেছিলেন “অপু দেশে আসলে তাকে নিয়ে আমি অনেক জায়গায় বেড়াবো”,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
৮টি বছর ধরে এভাবেই আমি একেরপর এক প্রিয়জন হারালাম, শুধু আমার জীবনে এমনটা ঘটেছে তা নয়, আমি নিশ্চিত প্রায় এককোটি প্রবাসীর জীবনেই কখনো না কখনো এমন সময় এসেছে। মাঝে মাঝে মনে হতো সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই, এ জীবন আর ভালো লাগে না। কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে যেত আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা প্রবাসী এক বড় ভাইয়ের কিছু কথা, তিনি বলেছিলেন ” অপু, প্রবাস এমন একটা জায়গা যেখানে আসা যায় তবে যাওয়া যায় না, হয়তো কোন একদিন তুমি দেশে বেড়াতে যাবে, তখন প্রথম ১৫ দিন সবাই জিজ্ঞেস করবে কবে আসলে? আর তারপরের দিন গুলোতে সবার জিজ্ঞাসা থাকবে কবে যাবে? অর্থাৎ তোমাকে তারা মেহমান হিসেবেই গ্রহণ করবে, তাছাড়া তুমি তো আর একা নও, তোমার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন আছেন তাদের কথাও তো তোমাকে চিন্তা করতে হবে, তোমার উপর অনেক দায়িত্ব”
“দায়িত্ব” এই একটি বাক্যেই যেন আষ্টে-পৃষ্টে আছে প্রতিটা প্রবাসীর জীবন। প্রবাসীদের আত্মাটা অনেক বড় থাকে, তারা নিজেদের কষ্ট লুকিয়ে রেখে সবার মুখে হাসি দেখতে চায়। আর প্রিয়জনের মুখের এই একটু হাসি দেখার জন্য কখন যে নিজেদের যৌবন-তারুণ্য হারিয়ে বসে তার খেয়ালই রাখে না,,,,,,,,,,,,,,,,
“সব পাখিই নীড়ে ফিরে”, বেঁচে থাকলে হয়তো আমিও ফিরবো। তখন পরিচিতজনদের সাথে আনন্দময় সময় কাটানোর পাশাপাশি খুঁজে ফিরবো সেই সব আত্মার স্মৃতি গুলো যাদের সাথে বছর ৮ আগে নিজের অজান্তেই সারা জীবনের জন্য বলা হয়ে গেছে “আবার দেখা হবে”,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সাইদুল ইসলাম অপু,
প্যারিস, ফ্রান্স
০২-০১-২০১৭ ইং