- অভিবাসন
- স্মৃতির আয়না – ১৮
স্মৃতির আয়না – ১৮
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:০৩:২৯,অপরাহ্ন ০৫ জুন ২০১৭ | সংবাদটি ২৫০ বার পঠিত
আহমেদ শামীম
স্মৃতি ছাড়া তো স্মৃতিকথা হয় না। এখানে স্মৃতি থাকতেই হবে। তবে আজ এমন একজন মনিষীকে নিয়ে লিখবো যার সম্পর্কে স্মৃতির বিষয়টি তেমনভাবে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু তিনি স্মৃতির দর্পনে আলোক রশ্মির মতো জ্বলজ্বল করছেন। যিনি আছেন পরম শ্রদ্ধার আসনে আধিষ্ঠ আমার বিবেকের মানসপঠে। সমাজ ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এমন মহান মানুষের কথা তুলে ধরাও কম গৌরবের বিষয় নয়। ক’দিন থেকেই ভাবছিলাম লিখবো লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই মহৎ মানুষটিকে নিয়ে। যদিও দীর্ঘ সময়ের অন্তর্ধানে তাঁর পুরো নামটি ভুলতে বসেছিলাম। ক’দিন আগে এক সময়ের আমার সহকর্মী সিনিয়র সাংবাদিক ও কবি আ.স. মাখনের মাধ্যমে কনফার্ম হয়েছি। দৈনিক সিলেটের ডাক-এর সাবেক সম্পাদক, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রয়াত আব্দুল হান্নান চৌধুরীর কথা বলছিলাম।
তাঁকে আমরা ‘জজ সাহেব’ নামে সম্মোধন করতাম। বেঁচে থাকার দিনগুলোতে অতি উচ্চাসনে অবস্থানকারী জনাব চৌধুরী ছিলেন সত্যিকার একজন আলোকিত মানুষ।তাঁর সম্পর্কে আমার মতো একজন অতি নগণ্য মানুষ ক্ষুদ্র পরিসরে যৎসামান্য লিখে কিছুটা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছি। যদিও আমাকে তিনি আদৌ চিনতেন কিনা সন্দেহ। যেহেতু আমাদেরকে চেনার মতো কোন সুযোগই দিতেন না। তাঁর অধীনে কাজ করার সৌভাগ্য হলেও তিনি কখনো ‘তোমার কি নাম?’ এ সামান্য ক’টি শব্দও উচ্চারণ করেননি। নিভৃতচারী এবং আত্মমুখি মানুষ ছিলেন জজ সাহেব। হয়তো পরিচিত গন্ডির বেড়াজালে নিজেকে আটকে রেখেছিলেন অতি সন্তর্পনে। কেন জানি না বাইরের জগত থেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না কোনদিন তাঁর মুখ থেকে। তিনি জীবদ্দশায় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কিনা আমি জ্ঞাত নই। হয়তো এর নেপথ্যে থাকতে পারে বড় কোন অভিমান । কিংবা বুকে চাপা ছিল হয়তো বেদনার বিশাল কোন কষ্টের পাথর।
অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনকারী নিরহংকারী নির্লোভ মানুষ ছিলেন জজ সাহেব। প্রচারের রাজ্যে বিচরণ করেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ। হাতের কাছে কত সুযোগ ছিল। কিন্তু কোন সুযোগই তাঁকে ধরা দিতে পারেনি।সহজ করে বলা যায়, তিনি পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন সবকিছু স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে। সততা কর্তব্যনিষ্ঠাকে যাপিত জীবনের সঙ্গি করেছেন কর্মময় দিনগুলোতে । জীবনের পাঠ চুকিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এ ক্ষণজন্মা মানুষটি। অথচ তাঁকে জানা হলো না, চেনা গেল না। মুখোমুখি বসে হলো না কোন কথা।
জজ সাহেব সিলেটের সর্বাধিক প্রচারিত জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘদিন। অথচ বাইরের জগৎ তো দূরের কথা; সংবাদপত্র জগতের মানুষেরা তাঁকে খুব কমই দেখেছেন। এমনকি সিলেটের ডাক-এর সব স্টাফই হয়তো তাঁকে দেখেননি। সত্যি বলতে কি, তাঁর কথা যদিও আলোকপাত করছি,কিন্তু তাঁকে তো খুব কমই চিনেছি। দেখেছিও হাতেগুণা ক’দিন। আর কথা হয়েছিল মাত্র ক’টি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর থেকে বেশি কিছু আমার স্মৃতির ভান্ডারে নেই। তবু তাঁকে নিয়ে লিখার প্রবল আগ্রহের কারণ হচ্ছে বিবেকের দায়বদ্ধতা।
জজ সাহেবকে যখন দেখেছি তখন তিনি বয়সে অনেকটা প্রবীন পর্যায়ে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন কর্মে তারুণ্য। প্রায় প্রতিদিনই অফিসে আসতেন। বিশেষ কারণ ছাড়া তাঁর অনুপস্থিতি ছিল না। তিনি থাকতেন সিলেট শহরতলীর মেজরটিলা এলাকায়। এটুকুই জানি তাঁর সম্পর্কে। কোনদিন যাওয়া হয়নি তাঁর বাসায়। এমনকি ভাল করে কথাও হয়নি। তিনি সিলেটের ডাক-এর সম্পাদক ছিলেন অথচ সম্পাদকীয় কোন নীতিমালায় কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করতে দেখিনি বা শুনিনি। পত্রিকার যাবতীয় বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক জনাব মুহম্মদ আব্দুস সাত্তারের সাথে। মাঝে মাঝে দেখতাম সাত্তার ভাই সকালের দিকে অফিসে আসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন,‘জজ সাহেবের সাথে মিটিং আছে।’ জজ সাহেব প্রতিদিন সকালের দিকে অফিসে আসতেন এবং সন্ধ্যার আগে চলে যেতেন। যে কারণে রিপের্টারদের সাথে তাঁর দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল কম। আমাদের ডিউটি থাকতো সন্ধ্যার পর। তবে সপ্তাহে একদিন আমি ডিউটি করতাম ডে সিফ্টে। সিফ্টের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহ সম্পাদক আ.স. মাখন ভাইয়ের ছুটি থাকায় আমাকে আসতে হতো। ঐদিনই কেবল জজ সাহেবকে দেখতাম। কিন্তু তিনি সারাক্ষণই নিজের রুমে থাকতেন। কেবল ওয়াসরুমে যাওয়ার সময় নিউজ রুমের ভেতর দিয়ে যেতেন। এসময় মুখোমুখি হলে সালাম দিতাম। তিনি সালামের জবাব দিয়েই হাসিমুখে চলে যেতেন।
আমি প্রত্যক্ষ করেছি, জজ সাহেব সব সময় মাথা নিঁচু করে চলতেন। কারো সাথে তেমন কোন কথা বলতেন না। তিনি পত্রিকার সম্পাদক ছাড়াও ছিলেন অন্যতম মালিক । অথচ অফিসে কে এলো বা কখন এলো, কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা-এসব বিষয়ে কোন কথাই বলতেন না। তাঁর প্রতিদিনই অফিস করা চাইই চাই। হরতাল অবরোধও তাকে দমাতে পারতো না। প্রয়োজনে তিনি সাইকেল চালিয়ে চলে আসতেন প্রখর রৌদ্রতাপ কিংবা বৃষ্টিবাদল উপেক্ষা করে। যাওয়া আসায় কমপক্ষে ৮মাইল সাইকেল চালাতেন এই পৌঢ় মানুষটি। যা এককথায় অতুলনীয়।
‘সিলেটের ইত্তেফাক’ খ্যাত দৈনিক সিলেটের ডাক-এর সম্পাদকের মতো পদে থাকা এবং সুদীর্ঘ ৪০ বছরের মতো বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন জজ সাহেব। আমরা দেখেছি প্রতিদিনই তাঁর নামে অসংখ্য দাওয়াতপত্র আসতো। বেশিরভাগ থাকতো প্রধান বা সম্মানিত অতিথি হিসেবে। কিন্তু তিনি কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন না। অনেকে অফিসে এসে অতিথি করতে অনুনয় বিনয় করতেন। তবু তাঁকে টলানো যেত না। তিনি প্রচারের কাঙ্গাল ছিলেন না। কখনো তাঁকে উদ্বৃত করে কোন নিউজ দেখিনি কিংবা আমি করিনি। প্রচারে কোন ধরনের আগ্রহ বা অভিলাষ প্রত্যক্ষ করিনি। তিনি নিছক চাকরি হিসেবে সম্পাদকের দায়িত্বে থেকেছেন। ইচ্ছে করলে তাঁর জন্য লীড নিউজ কোন ব্যাপারই ছিল না। পত্রিকার পাতা জুড়ে তাঁর সচিত্র বক্তৃতা-বিবৃতি ছাপা হলে বিশেষ দৃষ্টিকটু লাগার কথা ছিল না। অথচ তিনি এড়িয়ে যেতেন সকল প্রচারণা। নিজেকে তুলে ধরা বা জাহির করার কোন অভিপ্রায় লক্ষ্য করা যায়নি কখনো।
জজ সাহেব ছিলেন আপাদমস্তক একজন খাঁটি ও মহৎ প্রাণের মানুষ।তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে কত কিছুই লিখা যায়। কিন্তু তিনি তো সে ধরণের কোন সুযোগই দেননি। কিংবা আমি নিজ থেকে তা আয়ত্ব করতে পারিনি। সেজন্যে ব্যর্থতার কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করাতে হয়। সত্যি বলতে কি, সমাজ থেকে ভাল মানুষেরা নিরবে নিভৃতে চলে যান।সমাজের জন্য তারা অকাতরে কাজ করে যান, বিনিময় আশা করেন না।স্বার্থের জন্য তাদের করতে হয় না দৌড়ঝাঁপ। কিংবা তাদেরকে ‘বড়’ মানুষের তকমা গায়ে মাখানোর জন্য প্রচারেরও প্রয়োজন পড়ে না। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তারা সামাজিক কল্যাণ সাধনে থাকেন ব্রত। অথচ এসব সত্যিকার নিঃস্বার্থ মানুষকে আমরা তেমন মূল্যায়ণ করি না। কিংবা তাদের অনুসৃত পথ অনুসরণে আমরা নির্লিপ্ত থাকি । আমরা যেন আলো নয়, আলেয়ার পিছন ছুটে জীবনকে বিষিয়ে তুলি। নিজেকে পরিণত করি অনির্ভরতার প্রতীকে। যদি প্রকৃত গুণী এবং আলোকিত মানুষের জীবনকে সামনে রেখে আমাদের কর্মতৎপরতা ধাবিত হতো, তাহলে আমরা যেমন সমাজের জন্য পরিপূর্ণ কেউকেটা হতাম, তেমনি সমাজ জাতি উপকৃত হতো দারুণভাবে। এতো ভূমিকার কারণ হচ্ছে একজন সমাজহিতৈষী পরোপকারী নিঃস্বার্থ মানুষকে নিয়ে ভাবি মাঝেমধ্যে। আজ তাকে এখানে তুলে ধরে তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতা কিছুটা হলেও স্খলন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শুনেছি জজ সাহেব একসময় সিলেটের ডাক-এর সম্পাদকের পদ ছেড়ে চলে যান নিরবে নিভৃতে। কেউ কিছু টেরই পেল না। শুধু চাকরি নয়; নশ্বর এ পৃথিবী থেকেও চিরবিদায় নিয়েছেন চুপিসারে। সত্য সুন্দরের পুঁজারী জজ সাহেব জীবনভর থেকেছেন স্বীয় কর্তব্যনিষ্ঠায় অটল। কোন লোভ লালসাই তাঁর আদর্শ থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জজ সাহেবদের মতো মানুষের বড় বেশি প্রয়োজন সমাজ জাতি ও দেশের জন্য। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সত্যিকার এ মহান মানুষটির যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব হয়, সে মোনাজাত করি মহান রাব্বুল আল আমিনের দরবারে।