সিঙ্গাপুর : যেনো এক স্বপ্নপুরী [পর্ব-১]
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৫৪:৪০,অপরাহ্ন ১৬ অক্টোবর ২০১৭ | সংবাদটি ১৯৯৩ বার পঠিত
-
লোকমান আহম্মদ আপন
সিঙ্গাপুর। বিশ্বের অন্যতম সেরা পরিচ্ছন্ন, আর উন্নত একটি দেশ। ছোট্ট এ দেশটি যেনো এক স্বপ্নপুরী। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে সিঙ্গাপুরের রয়েছে আলাদা এক আকর্ষণ। শুধু পর্যটন আকর্ষণই নয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের একটি নিরাপদ জায়গাও এই সিঙ্গাপুর। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ছড়াকার, শিশু সাহিত্যিক, সম্পাদক লোকমান আহম্মদ আপন। আমাদের পাঠকদের জন্যে লিখেছেন তাঁর সাত পর্বের সিঙ্গাপুর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
১.
প্রথম দর্শনে প্রেম
-
সিঙ্গাপুরের অনেক গল্প শুনেছি। সিঙ্গাপুর নিয়ে কিছু লেখাও পড়েছি বিভিন্ন সময়। নিজের অজান্তেই দেশটি ভ্রমণের ইচ্ছা জেগে উঠে মনের গহীনে। সময় সুযোগও পেয়ে যাই এক সময়। আমি ও আমার নিয়মিত ভ্রমণসঙ্গী সরোয়ার হোসেন সুমন পরিকল্পনা করি একসাথে সিঙ্গাপুর, চায়না ও ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের। পরে আমাদের সাথে সামিল হয় সাইফুল ইসলাম নিপু। যথাসময়ে চায়নার ভিসাও হয় তিনজনের। সিঙ্গাপুরের ভিসার জন্যে তিনজনের পাসপোর্ট জমা দেয়া হয় একটি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সিঙ্গাপুর আমাকে ছাড়া বাকি দুইজনকে ভিসা দেয়নি। সিঙ্গাপুরের ভিসার মেয়াদও থাকে মাত্র একমাস। অগত্যা আমাকে একাই বের হতে হলো তিন দেশ ভ্রমণে। প্রথমেই সিঙ্গাপুর।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বোর্ডিং নেবার সময় চোখে পড়ে লম্বা লাইন। কারো হাতে মিস্টির প্যাকেট। কারো হাতে ছোটখাটো ভারি ব্যাগ। সিঙ্গাপুরে অনেক বাংলাদেশী কাজ করেন। এজন্যে এই রুটের ফ্লাইটগুলো সব সময় প্রায় ফুল হয়। টাইগার এয়াররাইনসের বিমানটি ঢাকা থেকে রাত এগারোটায় উড়াল দেয় সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে। আমি সব সময় বিমানের উইন্ডো সাইটে বসতে পছন্দ করি। খোলা আকাশ দেখি। বিস্তীর্ন খোলা আকাশে আলো আর মেঘের নানান রঙের খেলা আমার খুব পছন্দ। এবারও উইন্ডো সাইটেই বসেছি আমি। আমার পাশের সিটটি খালি থাকায় আমি বেশ রিলাক্স করে বসি। ছিমছাম ছোট্ট এই বিমানটিতে ফ্রি কোন খাবার দেয়া হয় না। খেতে চাইলে কিনে খেতে হয়। আধো ঘুম আধো জেগে থাকা অবস্থায় আমার পুরো রাত কাটে। আমি হেডফোনে গানশুনি আর জানলা দিয়ে অন্ধকার আকাশ দেখি। বাস, ট্রেন কিংবা বিমান, যাই হোক না কেনো, হেডফোনে গান না শুনলে আমার জার্নি আরামদায়ক হয়না।
গান শুনতে শুনতে আর রাতের অন্ধকার আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে সিঙ্গাপুরের আকাশে চলে আসি টেরই পাইনি। চার ঘন্টা দশ মিনিটের আকাশ ভ্রমণ কীভাবে যে কেটে গেছে টের পাইনি। টের পাইনি কীভাবে দুইহাজার আটশো পঁচাশি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে তন্দ্রা ভাব কেটে যায় আমার। আমি নিচে তাকিয়ে অনেক আলোর ঝলকানি দেখি। মেরিনা বে তে নোঙর করা বড়বড় জাহাজগুলোকে দেখে রঙিন ফানুস মনে হচ্ছিল।
-
বিমান যতো নিচে নামছে আমার উত্তেজনা ততোই বাড়ছে। এক সময় বিমান ল্যান্ড করে আস্তে আস্তে রান করতে থাকে। আমার চোখের অস্থিরতা বাড়ে। শেষ রাতের আরামের ঘুমটুকুও চোখ থেকে বিদায় নেয়। হঠাৎ আমার চোখ আটকে যায় এক জায়গায়। দেখি আমাদের বিমানটি ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে রান করে যাচ্ছে। সমান্য নিচ দিয়ে রান করে যাচ্ছে শতশত গাড়ি। তার মানে, বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি বিমান বন্দরের রানওয়ের ভিতর দিয়ে পাবলিক সড়কও গেছে! আমি অবাক হয়ে যাই উন্নত দেশের উন্নত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখে। দেশটির মাটি ছুঁয়ার আগেই তাদের উন্নত চিন্তার প্রতিফলন আমাকে এবং আমার হৃদয় মনকে আপ্লুত করে দেয়।
বিমান থেকে নেমে চ্যাংগি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিতরে ঢোকে আমার মুগ্ধতা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁলো। মোটা কার্পেটে মোড়ানো ফ্লোর। মাঝে মাঝে কৃত্রিম ঝর্ণা আর গাছ লাগানো। কৃত্রিম ময়ূর, কৃত্রিম ঝোপ ঝাড়, পাওয়ারফুল এয়ারকন্ডিশন, ঝকঝকে তকতকে বাথরুম, অটো পানি পানের ব্যবস্থা, কৃত্রিম লেক, গার্ডেন, ফ্রি ওয়াইফাই, সুশৃংখল ব্যস্ততা আমাকে মুগ্ধ করে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল নাÑ চ্যাংগি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর র্যাংকিংয়ে কেনো বারবার বিশ্বের সেরা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্বাচিত হয়।
-
শেষ রাতের ইমিগ্রেশনেও অনেক ভিড়। আমি শোনেছিÑ সিঙ্গাপুরের ইমিগ্রেশন নাকি অনেক সময় সিঙ্গাপুরে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয় কাউকে কাউকে। কিন্তু আমি নির্ভার আছি। ইমিগ্রেশনে বরাবরই আমি নির্ভার থাকি। আজ পর্যন্ত কোন দেশেই ঢোকার সময় আমার কোন সমষ্যায় পড়তে হয়নি। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে শুধু জিগ্যেস করেছে- সিঙ্গাপুর থেকে চায়নার গুয়াংজু (ক্যান্টন) যাবার রিটার্ন টিকেট সাথে আছে কি না? সেই টিকিট দেখেই ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্টে সিল মেরে দেয়। ইমিগ্রেশন শেষ করতে করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। ইমিগ্রেশন থেকে বেরুনোর সময় আমার সামনের রেটিং ডিসপ্লেতে এক্সিলেন্টেই টাচ করি। মজার ব্যপার হচ্ছে চ্যাংগি বিমানবন্দরের টয়লেটসহ বেশ কিছু সার্ভিস গেটের সামনে রেটিং ডিসপ্লে থাকে। ডিসপ্লেতে পাঁচটি অপশন আছে। চমৎকার, ভালো, মুটামুটি, খারাপ, খুব খারাপ। আমার ধারনা এর মধ্যে সবাই প্রথমটিই টাচ করতে বাধ্য হবে তাদের অনেক উন্নত সার্ভিসের কারনে।
বিমান বন্দরের ভিতরের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে আমি ইউএস ডলার চেঞ্জ করে সিঙ্গাপুর ডলার নিয়েছি। দশ সেন্টের একটি কয়েন ঢুকিয়ে বুথ থেকে বাবুকে ফোন দিলাম। বাবু সিঙ্গাপুরে থাকে। বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার জুড়িতে। খুব ভালো, ভদ্র আর আন্তরিক একটি ছেলে এই বাবু। আমার ফ্লাইট সিডিউল বাবুর জানা ছিলো। তাকে বললাম আমি ম্যাকডোনাল্ডের সামনে আছি। আমি একমগ কফি আর এক পিস কেক খেয়ে বাবুর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। ভিতর থেকে বাইরে সিঙ্গপুরের সকালের আলো ফুটতে দেখি। উত্তেজনা বোধকরি কতোক্ষণে সিঙ্গাপুরের রাস্তায় নামবো। বাবু আসতে আসতে সকাল ছয়টা বেজে যায়। আমরা কিছুক্ষণ বিমান বন্দরের ভিতরে বসে কথা বলি। তারপর আন্ডারগ্রউন্ডে নেমে মেট্্েরা রেলের টিকিট কাটে বাবু। কাঁচের দেয়ালের মেট্রোরেলে করে ভোরের আলোয় চারপাশ দেখতে দেখতে আমি প্রবেশ করি স্বপ্নপুরী সিঙ্গাপুরে আরো গভীরে। আমার নির্ঘুম চোখ নির্বাক হয়ে দেখে আর মুগ্ধ হয়, মুগ্ধ হয় আর দেখে। সিঙ্গাপুর আমাকে আপন করে নেয়। আমার ভালোলাগা নিমেষে ভালোবাসায় পরিবর্তন হয়। আমি প্রেমে পড়ে যাই ছিমছাম সুন্দর সাজানো গুছানো ছোট্ট একটি দেশ সিঙ্গাপুরের।
চলবে…