মৃত্তিকা সাহা :
প্রবাসী আয়ে মন্দাভাব কাটছেই না। ওমান ও কাতার ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ থেকেই প্রবাসী আয় কমছে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশিদের আয় কমে গেছে। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোয় তা দেশের হিসাবে যুক্ত হচ্ছে না। ফলে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমছেই।
প্রবাসী আয় সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে বাহরাইন থেকে এসেছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, কুয়েত থেকে ৯ কোটি ডলার, ওমান থেকে ৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, কাতার থেকে ৫ কোটি ডলার, সৌদি আরব থেকে ২১ কোটি ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। লিবিয়া ও ইরান থেকে আগে কিছু আয় আসলেও বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ওমান ও কাতার ছাড়া সব দেশ থেকেই আয় কমেছে। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। আয় কমলেও প্রবাসে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। জানা গেছে, প্রবাসী আয়ের জন্য বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। কেননা মোট প্রবাসী আয়ের ৬০ শতাংশই আসে এসব দেশ থেকে।এভাবে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তাদের মতে এখনো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এই প্রবাসী আয়। এই আয় মোট ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগের চেয়েও বেশি। তা ছাড়া, বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের বিশালসংখ্যক পরিবার এই প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকারদের পরামর্শসহ সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ব্যক্তি ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্যান্য বছরের মতো এবারো রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক অবৈধভাবে দেশে অর্থ প্রেরণকারী কিছু মোবাইল অ্যাকাউন্ট ও এজেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও এসব পদক্ষেপ কোনো কাজেই আসছে না।
সূত্র মতে, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রাপ্তি কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তেলের দাম হ্রাস, ইউরো এবং পাউন্ডের বিনিময় মূল্য পতন এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর কারণে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স। গত অর্থবছরেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরে। সূত্র মতে, প্রবাসী আয়ে গত অর্থবছরজুড়ে মন্দাভাব থাকায় প্রথম থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। আর প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে নানান উদ্যোগও নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উদ্যোগ কাজে আসছে না। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ।
এদিকে, প্রবাসী আয় কমার কারণ জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুটি প্রতিনিধিদল চলতি বছরের মার্চে গিয়েছিল সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব। তিন দেশে গিয়েই দলটি দেখেছে, বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘বিকাশ’-এর নামে রেমিট্যান্সের অর্থ গ্রহণ করা হচ্ছে। শুধু মোবাইল নম্বর দিয়েই টাকা জমা দেয়া যাচ্ছে। ৫-১০ মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশের বিকাশ হিসাবে ওই টাকা জমা হয়ে যাচ্ছে। কিছু এলাকায় ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘রকেট’-এর নামেও এ সেবা দেয়া হচ্ছে। এর নাম দেয়া হয়েছে ডিজিটাল হুন্ডি। প্রতিনিধিদল দুটির নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মো. আখতারুজ্জামান ও মহাব্যবস্থাপক মো. হাবিবুর রহমান। এর প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল হুন্ডি প্রতিরোধে বেশ কিছু এজেন্ট ও হিসাব বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অবৈধ আর্থিক লেনদেন ও ডিজিটাল হুন্ডির সঙ্গে জড়িত থাকায় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের ২ হাজার ৮৮৭টি এজেন্টের কার্যক্রম সেপ্টেম্বরে বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এক হাজার ৮৬৩টি গ্রাহক হিসাব বন্ধ করা হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী এসব সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিকাশের অভিযুক্ত এজেন্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকেও (সিআইডি) আলাদাভাবে চিঠি দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষায়ও দেখা গেছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এর একটি কারণ হতে পারে বিনিময় হারের পার্থক্য, দ্রুত অর্থ পাঠানোর সুবিধা ও কম খরচ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবকণ্ঠকে বলেন, হুন্ডির কারণেই মূলত রেমিট্যান্স কমছে। আর ব্যাংকের সঙ্গে খোলা বাজারে ডলারের দামের পার্থক্য অনেক বেশি হওয়ায় হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে আসার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে বিদেশে আছেন এবং অল্প পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে। এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংকে। এ জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ভুয়া এজেন্ট সেজে যাতে কেউ এ কাজে সহযোগিতা করতে না পারে সে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশিদের আয়ও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। যার প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে প্রবাসীরা দেশে ১১৫ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ এসেছে মাত্র ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ও আগস্টে ১৪১ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। মূলত ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশুসহ বাড়তি কেনাকাটার কারণে আগস্ট মাসে বেশি রেমিট্যান্স আসে। তবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই থেকে অক্টোবর) হিসাব ধরলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৭ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই-অক্টোবর চার মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ৪৫৫ কোটি ডলার।
২০১৬ সালে একই সময়ে এই আয় ছিল ৪২৫ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা এক হাজার ২৭৬ কোটি ডলার পাঠান। এই আয় আগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ কম এবং পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার, সেটিও তার আগের বছরের তুলনায় আড়াই শতাংশ কম ছিল। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। এ সময় ৭ লাখ ৫১ হাজার ৪১০ জন উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করতে গেছেন। এই সংখ্যা গত অর্থবছরের মোট জনশক্তি রফতানির ৮৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি গেছে সৌদি আরব, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। এত মানুষ গেলেও বিপরীতে কত মানুষ একই সময়ে ফিরে এসেছেন, তার কোনো নির্ভরযোগ্য উপাত্ত নেই উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক আরো বলছে, নতুন যারা গেছেন, তাদের প্রতি চারজনের একজন নারী। তারা অত্যন্ত কম বেতনে যাচ্ছেন। এটিও প্রবাসী আয় কমার আরেকটি কারণ। মানবকণ্ঠ