মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মরণে প্রবাসীর অনন্য উদ্যোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩৩:১১,অপরাহ্ন ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | সংবাদটি ৩৫৩ বার পঠিত
-
অপূর্ব শর্মা
অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার মতো সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘাবাসী ভুলতে বসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুফী চৌধুরীকে। তাঁর যুদ্ধগাথা ও আত্মত্যাগের আখ্যান হারিয়ে যাচ্ছিল কালের গহ্বরে। এলাকায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকায় বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানত না তাঁর আত্মত্যাগের কথা। তবে ২০০৯ সালের পর সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। বাঘার প্রত্যেকেই এখন সয়েফ উদ্দিন চৌধুরীর যুদ্ধগাথা সম্পর্কে অবগত। আর সেটা সম্ভব হয়েছে আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ইব্রাহীম চৌধুরীর কল্যাণে। প্রবাসী এ সাংবাদিকের অর্থায়নে এলাকায় নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সয়েফ উদ্দিন চৌধুরী (সুফী) স্মৃতি তোরণ’। দৃষ্টিনন্দন এ তোরণটি যেন সুফি চৌধুরীর একমাত্র স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ বাঘায় সিলেট-কানাইঘাট সড়কের পাশে। জানান দিচ্ছে, একাত্তরে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রাণ হারানো এই বীরের কথা!
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি সমৃদ্ধ গ্রাম দক্ষিণ বাঘা। সিলেট শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। শহর লাগোয়া এই উপজেলার এই এলাকাটি একসময় বেশ দুর্গম ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে ঠিকই অগ্রসর ছিলেন এই গ্রামের মানুষ। বিশেষত গ্রামের চৌধুরী বাড়িটি এলাকার মানুষের কাছে ছিল ‘আলোর দিশারি’। স্থানীয়দের বিপদে-আপদে যেমন এ বাড়ির লোকজন পাশে থাকতেন তেমনই সঠিক দিক নির্দেশনা দিতেন চলার পথের। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে স্বভাবতই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন এই বাড়ির লোকজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এলাকার তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন যুদ্ধযাত্রায়। শুধু পথ দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি তারা, বাড়ির দুজন চৌকস সদস্য মঈন উদ্দিন চৌধুরী এবং সৈনিক সয়েফ উদ্দিন চৌধুরী সুফী তাদের ১২ আত্মীয়স্বজন নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
মঈন উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ইপিআরের নায়েব সুবেদার আর সয়েফ উদ্দিন চৌধুরী সুফী ছিলেন সৈনিক। সুফি চৌধুরী ট্রেনিং শেষে মাত্র শুরু করেছিলেন কর্মজীবন। তাঁর চাকরি জীবনের ছয় মাসের মাথায় বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে আসেন বাড়িতে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। সুতারকান্দি চেকপোস্টে মিলিত হন অন্যান্য যোদ্ধার সঙ্গে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল এম এ রব। বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন সুফী।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ সহযোদ্ধা মঈন উদ্দিন আহমদ চৌধুরী (৯০) জ্বল জ্বল চোখে পেছনে ফিরে তাকান। জানান, ‘একদিন সুফী আমাকে দেশের অভ্যন্তরে যাওয়ার কথা বলে। মায়ের সঙ্গে দেখা করে আরও কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। আমি তাতে আপত্তি করি। কিন্তু এম এ রবের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি চলে যান দেশে। পরে জানতে পারি, দেশের অভ্যন্তরে প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর লেখা দুটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে।’
সেদিন কোনো বিপত্তি ছাড়াই গোলাপগঞ্জের দক্ষিণ বাঘার বাড়িতে পৌঁছেন সুফী চৌধুরী। মা যত্ন করে খাইয়েছিলেন ছেলেকে। সে রাতেই যাদের নিয়ে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সন্ধ্যার পরপরই লোক মারফত তাদের কাছে খবর পাঠান। সংবাদ পেয়ে ফারুক উদ্দিন ও জলিল মিয়া ছুটে আসেন সুফীর সঙ্গে দেখা করতে। সিদ্ধান্ত হয় রাতেই গোলাপগঞ্জের নারাপিংয়ের ছালেহ আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাড়ি দেবেন ওপারে। রাজাকাররা রাস্তায় তাদের পথ আটকালেও কৌশলে সেখান থেকে সটকে পড়েন তারা। সুফীর সঙ্গে দুটি গ্রেনেড থাকায় তারা ছিলেন নির্ভার।
ফারুক উদ্দিন জানান, ‘আমাদের দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন ছালেহ আহমেদ চৌধুরী। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন আমাদের সঙ্গে ভারত যাত্রার। কথা হয়, পুকুরে ডুবানো নৌকা তুলে এরাল বিল পাড়ি দিয়ে সীমান্তে পৌঁছার। এতে বাধ সাধেন তাঁর স্ত্রী। অনেক চেষ্টা করেও সে রাতে আমাদের সঙ্গী হতে পারেননি তিনি। এই পরিস্থিতিতে হাওরের পাশ দিয়ে ডামপাল হয়ে ভারতে যাওয়া ঠিক করি আমরা। যাওয়ার সময় ডামপালের লতিফ মিয়াকে সঙ্গে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। রাত দশটা নাগাদ লতিফের বাড়িতে পৌঁছাই। আমাদের দেখে খালাম্মা তড়িঘড়ি করে রান্না বসান। বলেন, অবশ্যই রাতের খাবার খেয়ে যেতে হবে। জবাই করেন মোরগ। কিন্তু রান্না আর শেষ করতে পারেননি তিনি। সশস্ত্র রাজাকাররা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে আমাদের তিনজনকে আটক করে। বাড়িতে না থাকায় রেহাই পায় লতিফ। ঘরের পাশের ডেটা খেতে গ্রেনেড দুটি রেখে আসায় সেগুলোও কাজে লাগাতে পারিনি আমরা। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে তাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে লতিফের ঘরে আগুন দেয় রাজাকাররা। গোলাপগঞ্জ সদরে নিয়ে গিয়ে পাক ক্যাপ্টেন বসারতের হাতে আমাদের হস্তান্তর করা হয়। প্রথমে গোলাপগঞ্জ থানায় এরপর সিলেট সার্কিট হাউসে এবং সর্বশেষ নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট মডেল হাইস্কুলের টর্চার সেলে। সব জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। দিনে সিলেট বিমানবন্দর এলাকায় খালি গায়ে কাজ আর রাতে নির্যাতন করা হয়। এখানে ১৫ দিন পার হওয়ার পর একরাতে আমাদের তিনজনকে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন বিকেল বেলা চোখ বেঁধে একটি জিপে করে সেই যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুফীকে আর ফিরে আসেনি সে। তাঁকে কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তা জানা যায়নি আজ অবদি।
মছির উদ্দিন চৌধুরী ও ফয়জুন্নেসা দম্পত্তির ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে সুফি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর জন্মের দুই বছর পর মারা যান মছির উদ্দিন। একমাত্র পুরুষ সদস্য হওয়ায় সুফীর দিকেই তাকিয়ে ছিল গোটা পরিবার। বড় হয়ে সে হাল ধরবে সংসারের, এই প্রত্যাশা ছিল মায়ের। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে নিয়েছিলেন সৈনিকের চাকরি। গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হয়, অনেকে ফিরে আসে ঘরে। তাদের হাতে শোভা পায় লাল সবুজের পতাকা। পাশের ঘরের মঈন উদ্দিন চৌধুরীও ফিরে আসেন। শুধু ফিরে আসেননি সুফী! ছেলে ফিরে আসবে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস লালন করেছেন তাঁর মা। ২০১৬ সালে চলে যান ফয়জুন্নেসা।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ বাঘায় গিয়ে দেখা যায়, খালি পড়ে আছে সুফী চৌধুরীর জন্মভিটা! কোনো স্থাপনা নেই, আছে একটি মাচাং। লাউগাছে আচ্ছাদিত সেটি। স্বজনরা জানান, বছরে দু একবার তাঁর বোনেরা আসেন বাড়িতে। মঈন চৌধুরীর ঘরে দিন চারেক অবস্থান করে পাড়ি জমান নিজের ঘরে।
যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসা সুফী চৌধুরীর বোন আছিয়া খানম চৌধুরী দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতা খালি করেছে আমার মায়ের বুক। জন্মভিটাকে করেছে ঘরহীন। বাড়িতে থাকার মতো কেউ নেই। তিনি ইব্রাহীম চৌধুরীর প্রশংসা করে বলেন, তিনি উদ্যোগ নিয়ে তোরণ নির্মাণ করায় সুফীর স্মৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে বলতে গেলে এখন এটাই একমাত্র অবলম্বন। তিনি বলেন, সুফীর কোনো ছবি নেই। তাই এই তোরণটি পরিবারের সদস্যদের কাছে বিশেষ কিছু।
ইব্রাহিম চৌধুরীর বলেন, সুফী চৌধুরী আমাদের অহংকার, গৌরব। দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এলাকার তরুণ প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানত না। তাঁর আত্মত্যাগের কথা সকলকে অবগত করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।