আদর্শিক দর্শনে শিল্প চর্চার বিকাশে এই যাত্রাপথ একটি ঐতিহাসিক সূচনার ইতিহাসকেই সাক্ষ্য দেয়। জীবন-সংগ্রাম-মুল্যবোধ বিকাশে শিল্পের অগ্রযাত্রায় সামিল হওয়াকেই একমাত্র অঙ্গীকার বলে মনে করে চিন্তাশীলতার বিশ্বাসবোধে সমর্পিত শিল্পের সত্ত্বা। সৃষ্টির মননশীলতা আর সমাজবাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর সমন্বিত সাধনাই শিল্প সংগ্রামের মৌলিক মেরুকরণকে সুস্পষ্ট করে।
শিল্পচর্চার এই দ্রোহের ভাবনা ও মুক্তচিন্তার বাক্-অধিকার প্রতিষ্ঠায় – প্রতি দুই বছরের অন্তে নিউইয়র্কে বৃহত্তর পরিসরে রুচিশীলতার উৎকর্ষতায় মানঋদ্ধ আবৃত্তি উৎসব পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। এই পর্ষদটির নামকরণ করা হয়েছে ‘নিউইয়র্ক রেসিটেইশন ফেস্টিভাল কমিটি’।
নিউইয়র্কসহ সংলগ্ন ট্রাই স্টেটের প্রায় অর্ধ শতাধিক আবৃত্তি শিল্পীদের উপস্থিতিতে এবং শিল্পকলার অন্যান্য শাখার নাট্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, বরেণ্য গুনিজনসহ প্রায় তিন শতাধিক আমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে মিলনমোহনায়, ২০১৮ এর নিউইয়র্কে প্রথম বারের মতো আয়োজিত আবৃত্তি উৎসব বিপুল সংখ্যক দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে – নন্দননিকেতনের সজ্জিত মিলনায়তন প্রাঙ্গণে সফলভাবে উদযাপিত হয়। উদ্বোধণী অনুষ্ঠানে আবৃত্তি উৎসবের সংগঠিত আয়োজক কাঠামোর ঘোষণাটিও ছিল খুবই আশাব্যঞ্জক, উৎসাহ উদ্দীপক ও বহুদিনের কাংখিত অব্যক্ত উচ্চারণেরই একটি ভাষ্য।
আবৃত্তিশিল্পী নাট্যকর্মী সুদক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠক আবীর আলমগীর এর নাম উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হবার ঘোষণা এবং খ্যাতিমান আবৃত্তিকার ও ধীমান সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব – শিল্পজন মিথুন আহমেদ এর নাম চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষিত হলে উপস্থিত অভ্যাগতরা মুহুর্মুহু করতালিমুখর হয়ে অভিনন্দন জানান এবং ২০১৮ আবৃত্তি উৎসব কমিটির সকল সদস্যবৃন্দ মঞ্চের সম্মুখে এসে সারিবদ্ধ স্বাগত জানায়।
সাংস্কৃতিক পরিচিতি: মিথুন আহমেদ
মিথুন আহমেদ আশির দশকে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আবৃত্তিকে পদ্ধতিগতভাবে পরিশীলনে নতুন চিন্তাজগত তৈরীতে বাচিক শিক্ষাক্রম পরিচালনা এবং শিল্পের প্রচলিত ছককে ভেঙে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রথা-বিপ্রতীপ আবৃত্তি প্রযোজনা নির্দেশনা দেন। আবৃত্তির জনপ্রিয়তা গড়ে
তুলতে মধ্য আশি থেকে এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একুশটি আবৃত্তি এবং চারটি শ্রুতিনাট্যের এ্যালবাম। তিনি বাংলাদেশে প্রথম শ্রুতি নাট্য চর্চার সূচনা করেন। শ্রুতি নাট্যে সহশিল্পী হয়ে যুগলবন্দীতে অভিনয় করেছেন আলেয়া ফেরদৌসী, তারানা হালিম, শিরিন বকূল ও শমী কায়সার।
১৯৮৬ তে বাংলাদেশের আবৃত্তি আন্দোলনের প্রথম সামষ্টিক প্রচেষ্টা ওয়াহেদুল হকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন’ এবং এর পর ১৯৮৭তে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আহবানে ‘আবৃত্তি শিল্পী সংসদ’ ও ১৯৮৯ তে সৈয়দ হাসান ইমাম ও কাজী আরিফের সাংগঠনিক দক্ষতায় গড়ে ওঠা ‘আবৃত্তিকার সংঘ’ এবং নব্বয়ের শুরুতে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পারিষদ’ এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মিথুন আহমেদ যুক্ত ছিলেন। আশির দশকের শুরুতে ১৯৮৪ তে ড.আলী রীয়াজের তত্ত্বাবধানে গড়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরশ্রুতি’ র সাথে যুক্ত ছিলেন শুরু থেকেই। তিনি ১৯৮৫ নটর ডেম কলেজে তৈরী করেন আবৃত্তির ক্লাব ‘সমবৃত্ত’। ১৯৮৭ সালে ‘স্বরশ্রুতি’ আয়োজিত তৃতীয় জাতীয় আবৃত্তি উৎসবের তিঁনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী। ১৯৮৭তে আবুল হাসানের অপ্রকাশিত কাব্যনাট্য ‘ ওরা কয়েকজন’ ১৯৮৮ সালে বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’ পাঠাভিনয়ে এবং ১৯৮৭ সালে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় জার্মান কালচারাল সেন্টার ‘গ্যাটে ইন্সটিটিউট’ আয়োজিত মহাকবি গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ রিডিং থিয়েটারে অভিনয় করেন। আবৃত্তির নবতর নিরীক্ষায় ১৯৮৮ তে নিজে গড়ে তোলেন ‘বাচনিক’ নামে বাকশিল্পের প্রতিষ্ঠান।
মিথুন আহমেদ আশির দশকের ১৯৮৪ সালে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় সক্রিয় হন এস. এম সোলায়মান নির্দেশিত নাটক দিয়ে ‘ঢাকা পদাতিক’ নাট্য দলের মাধ্যমে। । ১৯৮৬ তে প্রখ্যাত নাট্য নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরীর নাটকের মধ্যদিয়ে টেলিভিশনে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন। অভিবাসী জীবনে গড়ে তুলেছেন ‘থিয়েটার থিয়েটার’ নাট্য সংগঠন তাও প্রায় দুই দশককাল হলো। নাট্য আখ্যান রচনা, পারফরমেন্স আর্ট ও চারুশিল্পের প্রতি রয়েছে তাঁর গভীর অভিনিবেশ। বাংলাদেশের জাতীয় পরিস্থিতির সংকটে – রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম-আন্দোলনে মিথুন আহমেদ সক্রিয় অংশগ্রহণে সংযুক্ত ছিলেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ঘাতক দালান নির্মূল কমিটি, ১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন সাহসী সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধা। মিথুন আহমেদ নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। মিথুন আহমেদ বর্তমানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর লেখা নিবন্ধ – ‘সমাজ ভাষাতত্ত্বের নিরিখে সেলিম আল দীনের নাট্য আখ্যান’ এবং আবৃত্তি বিষয়ক মৌলিক তত্ত্বীয় গবেষণাপত্র: ‘বাকশিল্পের ভাষা নির্মাণ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাংস্কৃতিক পরিচিতি: আবীর আলমগীর
আবীর আলমগীর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চেতনার ধারাকে বিশ্বাস করেন বলেই ছাত্র ইউনিয়নের কালচারাল ব্রিগেড, ‘উদীচী’ ও ‘খেলাঘর’ এর সংগঠনগত কার্যক্রমের স্পৃহা থেকে উৎসারিত হয়ে নিজের শিল্পীমন গড়ে তুলেছেন সেই শৈশব থেকেই। নাট্যকর্মকান্ড এবং আবৃত্তির প্রতি আগ্রহশীল মনোভঙ্গী ও বিশেষিত দূর্বলতা তাঁর চর্চাক্ষেত্রকে বহুধা বিস্তৃত করেছে। তারুন্যর একটা সময় পর্যন্ত উচ্চাঙ্গ এবং রবীন্দ্র সংগীতে তালিম নিয়েছেন রংপুর শিল্পকলা একাডেমীতে।
গত তিন দশকেরও অধীক এই অভিবাসন যাপন তাঁকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি সেই স্বদেশীকতার দূর্নিবার আকর্ষন ও দেশমাতৃকার প্রতি অপরাহত দায়বদ্ধতা থেকে। যুক্ত রয়েছেন ‘ড্রামা সার্কল’ এর সাথে দীর্ঘ দুই দশকেরো বেশী সময়ধরে, বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন সভাপতি পদে। উত্তর আমেরিকার সামাজিক সংগঠনসমূহের বৃহত্তর প্লাটফরম ‘ফোবানা’র সাথে সম্পৃক্ত আছেন অতপ্রতোভাবে। সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি।সালেক খানের নির্দেশনায় হেনরিক ইবসেনের ‘ডলস হাউস’, জামাল উদ্দিন হোসেনের নির্দেশনায় জেবি প্রিসলির ‘এন ইন্সপেক্টর কলস’, সুদীপ্ত চট্রোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন তিনি।
আবীর আলমগীর ১৯৯৫ এ নিউইয়র্কের প্রথম দশর্নীর বিনিময়ে আবৃত্তি আয়োজনের ছিলেন একজন অন্যতম আবৃত্তিশিল্পী-সমন্নয়ক। মিথুন আহমেদের গ্রন্থনা পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ১৯৯৬ এ নজরুল সম্মেলনে দুইটি দীর্ঘ আবৃত্তি আলেখ্য এবং ১৯৯৭ এ জীবনানন্দ দাশ’র জন্মশতবার্ষিকীর বিশেষ বৃন্দ আবৃত্তি নিরীক্ষায় আবীর আলমগীর একজন গুরুত্বপূর্ণ আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে তখন থেকেই বিশেষভাবেই বিবেচিত হন। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক এর কুইন্স বোরো কলেজে থেকে স্নাতক এবং নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমী থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।
আগামী বছরগুলিতে আবৃত্তি উৎসবকে কেন্দ্র করে আমেরিকাসহ উত্তর আমেরিকায় আবৃত্তি শিল্প ও আবৃত্তিকারদের এক মহামিলনের মোহনায় প্রাণিত হবে সংস্কৃতির নব জাগরণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী সংহতি। আর তাই বাঙালীর অভিবাস নগরগুলির শিল্প-দিকরেখা প্রাঙ্গণমূলে শোভিত বৃক্ষরাজির ছায়ায় অপেক্ষমান আশা দিশেহারা উন্মুখ শ্রোতাগণ ।
সুত্র : খবর ডট কম