আহসান মঞ্জিল এবং ঢাকার নবাব পরিবার – (১)
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩০:২৫,অপরাহ্ন ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ১২৬১ বার পঠিত
আশিফুল ইসলাম জিন্নাহ:
ঢাকার বিখ্যাত খাজা ও নবাব পরিবার ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের যুক্তবাংলা প্রেসিডেন্সী প্রদেশের সবচেয়ে বড়, মর্যাদা সম্পন্ন এবং প্রভাবশালী মুসলিম জমিদার/ভূ-সামন্ত পরিবার। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ/আদি পুরুষ হচ্ছেন খাজা আব্দুল হাকিম। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের অভিমত থেকে জানা যায়, খাজা আব্দুল হাকিম তার ভাই খাজা আব্দুল্লাহকে সাথে নিয়ে তৎকালীন কাশ্মিরের চলমান রাজনৈতিক গোলযোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং ব্যবসা বাণিজ্যিক সুবিধার্তে সুদূর কাশ্মির থেকে সুবা বাংলায় চলে এসেছিলেন। এখানে আব্দুল হাকিম নিজে ঢাকায় থেকে স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করেন এবং তার ভাই আব্দুল্লাহকে সিলেটে রাখেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই। আব্দুল হাকিম প্রথমে কাশ্মির থেকে কাশ্মিরী শাল, এরপর কার্পেট ঢাকায় এনে বিক্রি করতেন। এই ব্যবসা থেকে তিনি প্রচুর অর্থ কামানোর পর উদ্বৃত্ত পুজি দিয়ে পরবর্তীকালে তিনি ও তার পরিবার স্বর্ণরেণু(স্বর্ণপাত) ও চামড়ার ব্যবসা শুরু করেন। ঢনাঢ্য খাজা পরিবারের ঢাকা নওয়াব এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শেখ আলিমুল্লাহ ঢাকায় তথা পুরান ঢাকার বেগমবাজারে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসা করতে থাকেন। সেখানে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর সংলগ্ন ইসলামপুরের কুমারটুলি এলাকায় অবস্থিত গোলাপী রং-এর আহসান মঞ্জিল নামক প্রাসাদ ভবনটি স্থানীয় ঢাকাইয়াদের কাছে নবাববাড়ি নামেই পরিচিত। এখানে প্রথমে বরিশালের জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েতুল্লাহ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে রংমহল নামক প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তিনি মারা যাবার পর তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ উক্ত রংমহলটি ফরাসী বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিলে ফরাসীরা এই ভবনকে বাণিজ্য কুঠি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে ফরাসীরা ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং তখন তারা তাদের এই বাণিজ্য কুঠিটি বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ১৮৩৫ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী ঢাকার প্রভাবশালী জমিদার খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসী বণিকদের কাছ থেকে এই বাণিজ্য কুঠিটি ক্রয় করেন। এরপর তিনি এই ভবনকে নিজ পরিবারের জন্য বসবাসযোগ্য এবং খাজনা আদায় সংক্রান্ত সদর কাচারি ভবন হিসেবে ব্যবহার করার উপযোগী করে সংস্কার করেন।
এরপর খাজা আলিমুল্লাহর পুত্র খাজা আব্দুল গণি মার্টিন এন্ড কোম্পানি নামক এক ইউরোপীয় প্রকৌশলী ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান দিয়ে খাজা পরিবারের পূর্বতন ভবনকে ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুনভাবে দ্বিতল প্রাসাদ ভবন নির্মাণের জন্য মাস্টার প্লান করান এবং এর ভিত্তিতে ১৮৬৯ সাল থেকে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বিত্তশালী ও বিলাসী আব্দুল গণি এই প্রাসাদ ভবন নির্মাণের জন্য সুদূর বিহারের রানীগঞ্জ থেকে উন্নত মানের ইট এনেছিলেন। ১৮৭২ সালে ভবনটির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত হলে আব্দুল গণি তার নিজ পুত্র আহসানুল্লাহর নামানুসারে ভবনটির নাম আহসান মঞ্জিল নামকরণ করেন। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকার বিখ্যাত প্রতিপত্তিশালী খাজা পরিবারের প্রধান এবং নওয়াব এস্টেটের মুতাওয়াল্লী খাজা আব্দুল গণি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক “নওয়াব বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হয়ে ঢাকার নবাব হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। এরপর তাকে বংশানুক্রমিক নবাব উপাধি গ্রহনেরও অনুমতি প্রদান করা হয়। এরফলে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের নবাব পরিবার ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ, জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ যুক্তবাংলা প্রেসিডেন্সির সর্বাধিক ঢনাঢ্য, মর্যাদা সম্পন্ন, প্রভাবশালী সামন্ত রাজপরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রথম নির্মাণকাল থেকে আব্দুল গণির সময় পর্যন্ত এই রংমহল/আহসান মঞ্জিল ভবনের ছাদের উপর কোনপ্রকার গম্বুজ ছিল না। ১৮৮৮ সালে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিল ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিশেষ করে অন্দরমহল সম্পূর্ণরূপে বিধবস্ত হয়ে যায়। এই সময় নবাব আহসানুল্লাহ সমগ্র প্রাসাদ ভবন সংস্কারসহ এর মধ্যস্থলে সুউচ্চ অষ্টাভূজাকৃতির কুদুমকলি গম্বুজ নির্মাণ করে এই প্রাসাদ ভবনের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং রাজকীয় আভিজাত্য বৃদ্ধি করেন। প্রাসাদের মধ্যস্থলের বর্গাকার কক্ষের মেঝ থেকে গোল করে মোটা ইটের গাথনি তুলে তার উপর এই গম্বুজ বসানো হয়েছে। ১৮৯৭ সালেও ঢাকায় সংঘটিত প্রবল ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিল ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নবাব আহসানুল্লাহ পুনরায় এর সংস্কার সাধন করেন।
আহসান মঞ্জিলের মূল ভবনটি পূর্ব থেকে রংমহল আর পার্শ্ববর্তী ভবনটি অন্দরমহল(জানানা)হিসেবে পরিচিত ছিল। কাঠের নির্মিত একটি ট্যানেল/সংযোগপথের মাধ্যমে দ্বিতীয়তলার উপর থেকে এই দুই ভবনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। প্রাসাদের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দুটি মনোরম খিলান আছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে গাড়ি বারান্দার উপর দিয়ে দোতলার উপর একতলা সমান উচু থেকে সুপ্রসস্ত খোলা সিড়ি সিংহ দুয়ার ও বাগানের সম্মুখস্থল পর্যন্ত নেমে গিয়েছে নান্দনিকতার ছোয়ায়। পূর্বে প্রাসাদের এই খোলা সিড়ি এবং বাগানের মধ্যস্থলে একটি পানির ফোয়ারা ছিল যা এখন নেই। এই দুইতলা বিশিষ্ট ভবনের ছাদ নির্মাণে সেগুন কাঠের কড়ি ও বর্গা ব্যবহার করা হয়েছে। অর্ধবৃত্তাকার খিলানের উপর থেকে ভবনের দরজা গুলো বসানো হয়েছে। দরজার ভেতর ভাগে নানা রং-এর কাঁচ আর বহিঃভাগে কাঠের খড়খড়ি লাগানো হয়েছে। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝেতে সুভ্র মার্বেল পাথর বসানো হয়েছে। গম্বুজের দুইপাশ থেকে সুসমভাবে প্রাসাদটি দ্বিভাগ হয়ে দুই দিকে প্রসারিত হয়ে গেছে। দোতালার পূর্বদিকে বৃহৎ ড্রইং রুম, উত্তরে লাইব্রেরি, কার্ড রুম এবং পশ্চিমদিকে ৪টি বর্গাকার আবাসিক কক্ষ। আর পশ্চিমদিকে বৃহৎ জলসা ঘর, উত্তরে হিন্দুস্তানী কক্ষ, পশ্চিমে আরো ৪টি বর্গাকার কক্ষ রয়েছে। ড্রইং ও নাচ ঘরের ছাদের মেঝের উপরের আবরনে কাঠের তৈরি ভল্টেড সিলিং(কাঠের পাটাতন) অত্যন্ত দৃষ্টি নন্দন। নিচতলার পূর্বদিকে বৃহৎ ডাইনিং রুম, ৪টি বর্গাকার কক্ষ, পশ্চিমে দরবার হল, উত্তরে বিলিয়ার্ড রুম। ডাইনিং ও দরবার হলের মেঝে সাদা, সবুজ, হলুদ রং-এর চীনা টালি দ্বারা অলংকৃত। পশ্চিমের ৫টি কক্ষের মধ্যবর্তী স্ট্রং রুম যেখানে নবাবদের অর্থ, অতি মূল্যবান ধনরত্ন, দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষিত থাকত। গম্বুজের উত্তরদিকে রয়েছে আকর্ষনীয় প্রশস্ত কাঠের সিড়ি। সিড়ির রেলিংয়ের অংশ আঙ্গুরের লতার নক্সা সমৃদ্ধ লোহার তৈরি ব্যলিস্টিক সিড়ি, ছাদের জ্যামিতিক নকশা সমৃদ্ধ সিলিং এবং বারান্দা সংলগ্ন কারুকার্য সমৃদ্ধ লোহার সিড়িটি অত্যন্ত আকর্ষনীয়। এই আহসান মঞ্জিল ছিল ঢাকার খাজা ও নবাব পরিবারের বাসস্থান ও দরবার প্রাসাদ। কথিত আছে, এটি ঢাকায় নির্মিত প্রথম ইমারত/ভবন।
asifultasin18@gmail.com