দেশান্তরের পথে পথে
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪৩:১৪,অপরাহ্ন ২০ এপ্রিল ২০১৭ | সংবাদটি ৫৪৯১ বার পঠিত
মনিরা প্রীতু
( একজন সৌখিন লেখিকা , লিখছেন দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় পত্রিকা অবজারবার সহ নানান মাধ্যমে, র্ইংরেজী বাংলায় দুটোয় পারদর্শি । থাকেন বাফেলো তে এখন থেকে লিখবেন নিয়মিত প্রবাবের নিউজে )
(১)খুব ছোটবেলায় যখন পায়ে হাঁটা পথ ধরে স্কুলে যেতাম, যখন বাস্তবতার সামনাসামনি হইনি, তখন সে যাত্রাটা ভালোই লাগতো। স্কুল, পাঠ্যবই, রঙিন বইয়ের ভেতরের রঙিন ফুল পাখি। একটু বড় যখন হলাম। বিশ টাকা রিক্সা ভাড়ার পথ যেতাম। তাও বিদ্যার্জনে। ফিরতি পথে বারান্দার টবের ফুল দেখতে আসতে চাইতাম, যত তাড়াতাড়ি পারি। তখন একটু ক্লান্ত হতাম, অইটুকু পথ চড়ে এসে।
আরো বড় হলে মহাবিদ্যালয় ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ব জোড়া পাঠশালা যে! তখনকার যাত্রা আর যাত্রাপথের ক্লান্তি-শ্রান্তি সহজেই অনুমেয়। আর তারপর! চার বছর পর অসহনীয় লাগতে শুরু করেছিলো সে যাত্রা। প্রায় চার ঘন্টা বাসে, ট্রেনে আবার ট্রেনে, বাসে। সেই ছড়াটার মতো। বাসে চড়ি, ট্রেনে চড়ি। বারবার মনে হতো উফ! আর কতো!
তিনবছর আগে থেকে শুরু হলো জার্নি শশুরবাড়ি টু বাপের বাড়ি। এন্ড ভাইস ভার্সা। কখনো সাত কখনো আট ঘন্টা। ট্রেনে চড়া। হরতাল অবরোধে আরো চার পাঁচ ঘন্টা বাড়তি যোগ। ধুলো বালি আর যাত্রার ক্লান্তিতে বারবার মনে পড়তো ডাস্ট এলার্জি আছে আমার, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, কখন যে পৌঁছাবো বাসায়! প্যানিক হয়ে পড়তাম। বাবার বাড়িতে এসে উইন্ড রিলেক্সেশন। শশুরবাড়িতেও তাই। মাঝখানে যাত্রাটাই যা তা!
তবে এ বারের যাত্রাটা ছিলো অনন্যসাধারণ। একই সাথে অসীম আবার সীমিত। জীবনে নাকি ছুটে চলতে হয়। যাত্রার শেষ নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো এ যাত্রাই শেষ। বসন্ত থেকে উল্টে আবার সোজা শীতে। রাস্তাটা ছিল শুন্যে। মেঘে চড়ে। অদ্ভুত সে যাত্রা। বাইরে শুন্য ভেতরটা ভরা! বসন্তে ভরা হৃদয়।
বিভুতির দেশ ছেড়ে ফ্রস্টের দেশে। সবই তো ঠিক, সবই তো এক। আবার ভীষণ রকমের আলাদা।
একা একা এই প্রথম এত দুরে এসেছি।
ভেবেছিলাম একটু হলেও হাঁটু কাঁপবে! কিন্তু নাহ! মনের জোর হাঁটুর উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলো। খুব সটান ছিলাম আসার দিন। এর আগের পুরো সপ্তাহটাই মৌমাছি ছিলাম। ব্যস্ত ব্যস্ত ব্যস্ত। ব্যস্ততা অনুভব করার অবসরটুকুও ছিলোনা। বিদায় উৎসবে রাজা, রাণী, মন্ত্রী, কোটাল, প্রজা, প্রহরী, সই-সখী সবাই ছিলো। কিন্তু যে ছিলোনা, সে রাজকুমারের কাছে যাওয়ার জন্যই এ উৎসব। এ যাত্রায় আমি এসেছি শুধু আমার সাথে। সাথে নিয়ে সব ভালোবাসা।
(২)বরফের পাহাড় সরে যেতেই আবিষ্কার করলাম মৃত গাছগুলোকে! চারদিন ধরে ছিল একই চিত্রপট। বিশাল এক ডীপ ফ্রিজের ভেতরের দৃশ্য দেখি জানালা খুললেই। আর সে বরফপথ বেয়ে আসা কঠিন বাতাস। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার মত ফুরসত পাইনি সে বরফবাতাস উপেক্ষা করে। আজ হঠাৎই চমকে গেলাম বাদামী কান্ডগুলো দেখে। চোখ শীতলকরা সবুজ নেই কোথাও। কিন্তু তার বদলে পবিত্র শুভ্রতার সমাহার এখানে।
জাদুকরের ছড়ি ঘুরানোর আগেই এখানে বরফ গলে বৃক্ষের উদয় হয়ে যায়। কি আশ্চর্য সুন্দর! গাছের পাতা না থাকলেই কি সে গাছের মর্যাদা কমে যাবে! উহু, পত্রবিহীন গাছ যেন সন্তানবিহীন বাবা মায়ের মত। বরফের দিন শেষে এরাও পত্রপল্লবে পুষ্ট হয়ে পুর্ণতা পাবে। আকাশের দিকে তাকালাম। হুমায়ুনের সে ‘নিউইয়র্কের আকাশে এখন ঝকঝকে রোদ!’
বিদেশের মাটি বলে যে ব্যাপারটা আছে সেটা মনে হচ্ছেনা একটুও। এই মাটিভেদ করে বেড়ে উঠা ছোট্ট গাছ, এই নির্মল মেঘ উড়ানো আঁকা ছবির মত আকাশ, অল্পতেজি কমলা সুর্য, ইট কাঠের সাজানো বাড়ি, সাদা কালো জেব্রা ক্রসিং আঁকা বিশাল রাস্তা, আধা খোলা জানালায় অচেনা কারো মুখ, নির্জন খোলা রাস্তার পাশে শুকনো গাছের বিশাল ডালগুলো তাদের চির পরিচিত বাতাসে দোদুল্যমান, এগুলোর কোনোটাই আমার অপরিচিত লাগছেনা। মনে হচ্ছে এগুলো আমারই, যুগ যুগ ধরে।
ভালোবাসার গন্ডি নেই কোনো। ছোট্ট একটা পাখি সে যেখানকারই হোকনা কেন, আমার পুর্ণ মনযোগ পাওয়ার জন্য শুধু তার এই পাখি হয়ে জন্মানোটাই যথেষ্ট। হোকনা এ রাস্তায় ধুলো নেই, স্বদেশের রাস্তার ধুলোতেই যে সব প্রেম থাকবে তাই বা বলি কি করে! এ ধুলোবিহীন পিচের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালে সুর্যের কোমল রোদ ভারী জ্যাকেট ভেদ করেও আমার রন্ধ্রে পৌঁছে যায়।
এই আকাশের মেঘ যে ভাসতে ভাসতে আমার দেশ থেকে আসেনি তাই বা বলি কেমন করে! ওদের চলার তো শেষ নেই। একই সুর্য তো আমার দেশেও আলো দিয়ে এসেছে, ক ঘন্টা আগে। এই আগ পিছু লুকোচুরি খেলা ভেবে মনে মনে পুলকিত হই। সুর্যকে হাত নেড়ে স্বাগত জানাই। বিরামহীন চলা যে তার! ছোট্ট গাছগুলোকে ভালোবেসে ফেললাম ক্ষণিকের মধ্যেই। কত লড়াকু এরা। এই বিরুপ বরফজমা মাটিতে মুখ বুজে পড়ে থাকে, শীতলতম সময়ের পর একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেতেই হেসে খেলে উঠে। মৃদু বাতাসে দোল খায়। ঠিক ওদের দেশের মানুষদের মতই হাত নেড়ে কুশল বিনিময় করে। বরফমুক্ত গাছগুলো মুহুর্তেই কসমোপলিটান থিওরি নিয়ে এলো মনে।
প্রকৃতির রুপ ভীষণরকমের সম্মোহক। আমি সম্মোহিত হই। এক, দুই, তিন! তারপর সে সম্মোহন কেটে যায়। যার জন্য ভালোবাসার এ দেশ কাল স্থান পরিবর্তন, তার আগমনে ঝোঁক কেটে যায়। এককেন্দ্রিক হয়ে উঠি নিমেষেই। রসালের স্বর্ণলতিকা হই। বিশাল বৃক্ষকে পেঁচিয়ে যে স্বর্ণলতার বাস সে সত্যকে অস্বীকার করতে যাবোনা কখনোই।
গাছগুলোকে হাত নেড়ে বিদায় দেই সেদিনকার মত! আবারো আসবো আমি। ওদের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে, ওদের পরিবর্তিত সে গল্প শুনতে ও শোনাতে। আমাকে আসতেই হবে। আসমুদ্রহিমাচল সবই যে আমার জন্য এক। প্রতিদানহীন ভালোবাসার উপযুক্ত।
(৩)ফুলগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় এক অমোঘ টানে দাঁড়িয়ে গেলাম। হাত নেড়ে ডাকেনি বলছো? ওরা আমায় ঠিক ডাকে। আমিই শুধু সে ডাক শুনতে পাই। ফুলগুলোকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে একটু মায়ার হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলো হাঁটার পার্টনার, আমার যন্ত্রমানব। হাত নেড়ে ডাকছে আমায়।
দেরি না করে টপাটপ মোবাইল বের করে ঝপাঝপ ক্লিক করলাম। ওদের ছবি তুলতে তুলতে সে অনেকটা এগিয়ে এলো আমার আর ফুলগুলোর দিকে। ক্ষাণিক পরে আমার স্বগতোক্তি ‘এগুলো আমি একদিন না একদিন চুরি করবোই’ শুনে আমার সাধ্যের অতিরিক্ত রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলা যন্ত্রমানব বললো ‘চুরি করবা কেনো? কিনে দিবো পছন্দ হলে।’
আমি ফিলসফারের মত একটু উদাসীন ভাব নিয়ে বললাম ‘দোকানে পসরা সাজিয়ে যে ফুলগুলো বিক্রি করে সেগুলো নিতান্তই ভালো আর টিপটপ। ত্রুটিহীন না হলে লোকে পয়সা খরচ করে কিনবে কেনো! অই ফুলগুলো আমার কাছে অনেকটা শোকেসে সাজিয়ে রাখা নতুন বইয়ের মতো। নিজ দায়িত্বে বেড়ে উঠা, অযত্নে অবহেলায় বড় হওয়া ফুল দোকানের ফুলের মতো নিখুঁত নয়, এগুলো র্যানডম। বুনো একটা ব্যাপার আছে।’ আমার চোখের উদাসীনতা ইতিমধ্যেই লোভী দৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়েছে।
‘পুরানো বইয়ের প্রাচীন গন্ধটা যেমন নতুন কেনা বইতে পাওয়া যায়না তেমনি দোকানের কাঁচি দিয়ে সমান সাইজ করে কাটা ফুলের তোড়াতে বুনোফুলের নিজস্ব আবেদনটা থাকেনা। তাই কোন না কোন দিন চান্স পেলেই রাস্তা থেকে নিয়ে যাবো এই ফুল। ফুল কুঁড়ানোতে আমার জুড়ি নেই। ছোটবেলায় ফুলকুঁড়ানি খেলায় ফার্স্ট হয়েছিলাম আমি। আর তাছাড়া ফুল চুরি করার মধ্যে ব্যাপক আনন্দ আছে যেটা তুমি বুঝবানা।’
রাস্তার পাশের এলোমেলো ফুলগাছের দিকে লোভাতুর নয়নে তাকানোর ভঙ্গি দেখে যন্ত্রমানব এই বেলা বিপর্যস্ত একটা লুক দিলো। বললো ‘আশ্চর্য! ফুল চুরি করার কি আছে?’ আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম, খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ভুবন ভুলানো হাসি।
তাড়াতাড়ি তাকে আশ্বস্ত করতে চাইলাম। বললাম ‘আহা সত্যি সত্যিই ফুল চুরি করতে যাচ্ছিনা। ফুল চুরি করবো, এটা ভাবার মাঝেই একটা ব্যাপক আনন্দ আছে যেটা এজ ইউজুয়াল তুমি বুঝবানা। প্ল্যানিং করেও মজাটা নিতে দিবানা, নাকি!’ যাহোক, কোনমতে বুঝ দিয়ে আবারো হাঁটতে লাগলাম।
চারপাশের প্রকৃতি বদলাতে শুরু করেছে ইদানিং। কদিন আগে বসন্ত থেকে উল্টে সোজা শীতে চলে এসেছিলাম। এখন আবার বসন্তে প্রবেশ করছি। এবারের বসন্তটা অন্যরকম। অন্য বসন্ত। আর সে অনন্যসাধারণ বসন্তকে হেসে খেলে হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে পিচের রাস্তার পাশে আর প্রত্যেক বাড়ির ঠিক সামনে বেড়ে ওঠা নাম না জানা এ বাহারি ফুলের গাছগুলো।
ভীষণ মায়াবী বিকেলে সুর্যের শেষ আলোয় নরম পাপড়ি মেলা এই ফুলেরা আমাকে মনে করিয়ে দেয় মিরিয়ামের কথা। নিয়ে যায় ডি এইচ লরেন্সের সেই গল্পের নায়িকার কাছে যে কিনা প্রেমিক পল এর হাত ধরে রোজ বিকেলে হেঁটে যেতো রঙিন ফুলের মাঝ দিয়ে, আর সময় পেলেই কুঁড়িয়ে নিতো থ্রি-নট-থ্রি অথবা ফরগেট-মি-নট ফ্লাওয়ার।
আমি চারপাশে চেয়ে চেয়ে দেখি। এ দেখা ফুরায় না যেনো। বারবার পেছনে পড়ে যাই হাঁটার সঙ্গী থেকে। তারপরেও আমি আবিষ্কারের খুশীতে অদম্য। আবার একচ্ছুটে ফিরে যাই সখার কাছে। হাতে হাত রেখে বলে যাই সব বাহারি ফুলের গল্পগাঁথা। সাথে করে নিয়ে যেতে না পারলেও মনের গহীনে ওদের সৌন্দর্য লালন করার অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে যাই সামনে, যেখানে আমাদের শহর, আমাদের ছোট্ট ঘর।
Monira Pritu
Buffalo, New York