ফ্রান্সে এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:১৬:২৩,অপরাহ্ন ১০ মার্চ ২০১৮ | সংবাদটি ৫২৩৮ বার পঠিত
-
এনায়েত হোসেন সোহেল, প্যারিস, ফ্রান্স থেকে
পুরো জীবনটাই মানব সেবায় কাটিয়ে দিলেন। অথচ মৃত্যু কালে স্বীকৃতি ছাড়াই কমিউনিটির অবহেলা অনাদরে প্রচন্ড এক অভিমান নিয়ে নীরবে চলে যেতে হলো। যে মানুষটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযোদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধে পাকসেনাদের গোলাবারুদে আহত হয়েছিলেন , হারিয়েছিলেন নিজের একটি চোখ। সেই অকুতোভয় বীর যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সাধু মিয়ার এমন প্রস্থান মেনে নেয়ার মতো নয়।
ফ্রান্স বাংলা কাগজ কমিউনিটি এওয়ার্ড ২০১৮ প্রদান করা হবে আগামী ১লা এপ্রিল ২০১৮ রোববার। ফ্রান্সের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন মূলত তাদেরকে সম্মাননা জানানো এ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের প্রধান লক্ষ্যে।
যাদেরকে সম্মাননা প্রদান করা হবে রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করে তাদের একটি তালিকাও তৈরী করেছিলাম। যেহেতু আমি বাংলা কাগজের ফ্রান্সের ব্যুরো প্রধানের দায়িত্বে রয়েছি তাই বিষয়টি আমাকে বিশেষ করে দেখভাল করতে হচ্ছে।
সম্মাননা জানানোর জন্য আমি প্রথমেই যার নাম বিভিন্ন জনের কাছ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে পেয়েছি তিনি হলেন সদ্য প্রয়াত যুদ্ধাহত মুক্তিযযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সাধু।গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার সন্ধ্যার পর বন্ধু আব্দুল খালিক বলুকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে তাঁর অবস্থানস্থল সমাজকর্মী হো চি মিন এর সেন্টডেনিসের রুই গ্যাব্রিয়েল প্যারি রোডের ১৩৩ নং বাসায়।
বাসায় ঢুকতেই সাধু ভাইকে দেখলাম ফুরফুরে মেজাজে সোফায় বসে আছেন।ক্লিন সেভ। পড়নে কালো কোর্ট। গলায় বাদামি কালার মাফলার পেঁচানো।যদিও দু চোখে দেখতে পাননা তবুও বুঝার উপায় নেই। কাছে টেনে বসালেন। কুশল বিনিময় হলো। ধীরে ধীরে গল্প জমে উঠলো। সুখ দুঃখের গল্প। পাওয়া না পাওয়ার গল্প। তবে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই অনুযোগ নেই সরল উক্তিতে বুঝা গেলেও প্রচন্ড এক অভিমান তাঁর হৃদ মন্দিরে দোলায়িত রয়েছে অনুভব করলাম।
পুরো নাম মোহাঃ নজরুল ইসলাম। ডাক নাম সাধু। তাঁর বাবা নাকি শখ করে সাধু নামেই ডাকতেন। তাই এ নামে স্বজনরা ডাকতেন বেশি। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ৫ নং হলদিপুর ইউনিয়নের বাউধরণ গ্রামের মৃত মোহাঃ ইসহাক মিয়া মাষ্টার ও মৃত মোছাম্মৎ রায়বান বিবির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। অন্যান্য ভাইরা হলেন, রউফ মিয়া,রফিক মিয়া ও নুরুল ইসলাম। এক বোন। নাম হাসনা খাতুন। নজরুল ইসলাম সাধুর জন্ম ১৬ই ডিসেম্ভর ১৯৪৫ ইংরেজি।
নজরুল ইসলাম সাধুর হাতেখড়ি বাউধরণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন।১৯৬৬ সালে দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭০ সালে সিলেটের মদনমহন কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন।এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
প্রথমে বালাট টেকেরহাট হয়ে ভারতে যান। সেখানে মেজর শফিউল্লাহর তত্বাবধানে গেরিলা ট্রেনিং নেন। দুই মাস ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে এসে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। এ সময় তিনি ধীরাই,জগন্নাথপুর ,শাল্লা ও ছাতকসহ সিলেটের বিভিন্নস্থানে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।
নজরুল ইসলাম সাধু জানান.মুক্তিযোদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর সান্নিধ্য পান এবং তাঁর নির্দেশনায় বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন।
-
মুক্তিযোদ্ধের শেষের দিকে নজরুল ইসলাম সাধু ডাবর নামক স্থানে পাক সেনাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে আহত হোন। এ সময় তার বাম চোখ আঘাত প্রাপ্ত হয়। সেই সাথে শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম হয়। এই যোদ্ধে তাঁর সহযোগী সিলেট শহরের কামাল,ধীরাই থানার তাহের,ছাতকের রনি চন্দ্র দাস শহীদ হোন। ডাবর যুদ্ধে আহত হবার পর তিনি ডাবর টেকেরহাট ক্যাম্পে চিকিৎসা নেন। যুদ্ধের সময় সহযোগীদের আত্বত্যাগ তাঁকে খুবই পীড়া দিতো। তাদের স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেড়াতো। চিকিৎসাকালীন ১৬ ডিসেম্ভৰ ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে তিনি ১৮ই ডিসেম্ভর দেশে আসেন এবং সিলেট শহরের গোয়াই পাড়ায় নিজ বাসায় মমতাময়ী মাকে দেখতে যান।
-
নজরুল ইসলাম সাধু ১৯৭৩ সালে ঢাকা কলেজে বিএতে ভর্তি হোন। কলাবাগানে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদের বাসায় অবস্থান করে পড়াশুনা চালিয়ে যান। ৭৫ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এ সময় ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকায় বঙ্গবন্ধু,সামাদ আজাদ ,ফরিদ গাজী,সুরঞ্জিতসেন গুপ্তের সান্নিধ্য পান। এমনকি জাতীয় চার নেতার সাথেও তিনি তিনদিন জেল খাটেন।
রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে একপর্যায়ে তিনি সকল নেতাদের পরামর্শে ১৯৭৭ সালের ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ত্যাগ করে জার্মান আসেন। সেখানে তিনি চার বছর অবস্থান করেন।
১৯৮০ সালের ১৫ই ডিসেম্ভর নজরুল ইসলাম সাধু ফ্রান্সে আসেন। ফ্রান্সে অবস্থান কালে ৮১ সালের ১লা আগস্ট তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান।
ফ্রান্সে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাবার পর নজরুল ইসলাম সাধু ১৯৮২ সালে গার দো লিয়নের ষ্টেশনে কাজ নেন। প্রায় ১১ বছর একটানা সেখানে কাজ করেন। এরপর তিনি টাটা কোম্পানিতে দুই বছর কাজ করেন। তারপর তিনি অন্যান্য প্রতিষ্টানে দীর্ঘদিন কাজ করেন। এ সকল প্রতিষ্টানে কাজ করে যা মাইনে পেতেন নির্দ্বিধায় ফ্রান্সে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যানে শেষ করে দিতেন। তাঁর পৃষ্টপোষকতায় অনেকে কাগজ, বাড়িগাড়ির মালিক হয়েছেন।
১৯৯০ সালে ফ্রান্সে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ গঠন হলে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামীলীগের কমিটিতে নাজিম উদ্দিন সভাপতি ও সোহরাব মৃধা সাধারণ সম্পাদক হলে ওই কমিটিতে তিনি সিনিয়র সহ সভাপতি মনোনীত হোন। একই পদে তিনি একটানা দশ বছর থেকে দলের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
-
১৯৯০ সালে ফ্রান্সে সিলেট বিভাগ সমাজ কল্যাণ সমিতি গঠিত হলে তিনি আহবায়ক মনোনীত হোন। এরপর একাধারে পরপর তিনবার আহবায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৯৯১ সালে নজরুল ইসলাম সাধু বাংলার প্রতীক – নাম একটি ফুটবল দল তিনি গঠন করেন।এ দলের সভাপতি ছিলেন তিনি। ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ফুটবল খেলায় তিনি এ সময় বিরাট ভূমিকা পালন করেন। আর্থিকভাবে তিনি অনেক অবদান রাখেন। ১৯৯২ সালে ফ্রান্সে সুনামগঞ্জ সুনামগঞ্জ সমাজকল্যাণ সমিতি গঠন করেন নজরুল ইসলাম সাধু।সমিতিতে তিনি প্রথমে আহবায়ক হোন। পরবর্তীতে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ , রাজনীতি ,সমাজনীতিতে কাটিয়ে দেন নিরামিষ জীবনটা। চিরকুমার এই বীর সেনানী বর্ণাঢ্য জীবনের যাবতীয় সঞ্চিত অর্থ নির্ধিদায় দিয়ে যান মানুষের তরে। হয়ে পড়েন নিঃস্ব ,রিক্ত অসহায়।
এক সময় তাঁর শরীরে বাঁধে নানান রোগ।দেখতে পারেন না দু চোখে। অন্যের সহযোগিতায় চলতে হয় থাকে। ধীরে ধীরে কাছের লোকেরা সটকে পরে। চরম অবহেলা আর অনাদরে পড়তে হয় থাকে। সেই যে দেশ ছেড়েছিলেন আর যাওয়া হয়নি প্রিয় বাংলাদেশে। একাকী হয়ে পড়েন এই নশ্বর ধরাধমে।চোখ অপারেশনের জন্য সামান্য টাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় থাকে। যে দেশ ও দশের জন্য জীবনটাই অকাতরে বিলিয়ে দিলেন সেই মানুষেরা মুখ ফিরিয়ে নিলো। জীবন সায়াহ্নে এসে রিক্ত নিঃস্ব এই কালজয়ী বীর সেনানী হয়ে পড়লেন বড় অসয়ায়। প্রচন্ড এক অভিমান ছিল মনের গহীনে।
গত ৭ই মার্চ ছিল তাঁর চোখ অপারেশন। ইচ্ছে ছিল একটু দেখতে পেলে চলে যাবেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। জীবনের শেষ কয়টি দিন কাটিয়ে দিবেন কাদামাটির গন্ধে। কিন্তু তা আর হলোনা। ৫ মার্চ রাতে হার্ট এটাক হলো। ৭ই মার্চ অনেকটা অভিমান করে নীরবেই চলে গেলেন এই নশ্বর পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
যেখানেই থেকে প্রিয় নজরুল ইসলাম সাধু ভাই ভালো থেকো। আল্লাহ তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দেন করুন। আমিন।