পরবাস প্রজন্ম: বিদেশে বেড়ে ওঠা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৩:৩১,অপরাহ্ন ২৭ মে ২০১৯ | সংবাদটি ১৩১২ বার পঠিত
-
তিশা সেন
বিদেশে বড় হওয়া খুব মজার ব্যাপা, তাই না? অনেকরে ধারণা তাই। বিশেষ করে কিশোরজগতে এ কল্পনার রঙিন ঘুড়িটা নানা রহস্যেঘেরা। ভালো থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা, সব ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা বেশি বিদেশে এমন চিন্তা আমাদের দেশের কিশোর মনের। আসলে ব্যাপারটা কে যতো মজার ভাবি, ব্যাপারটা ঠিক ততটা মজারও না। বিদেেশে বেড়ে ওঠা আমাদেরও না বলা অনেক কষ্ট আছে।
সব মানুষেরই ভিন্ন গল্প থাকে। কখনও কাহিনী পুরোটা মিলে গেলেও, গল্পের মোড় বা শেষ টা ঠিকই ভিন্ন হয়। সবার জীবন যেমন ভিন্ন, তেমন জীবনে নেয়া সিদ্ধান্ত গুলোও খুব একটা মিলে না। আমরা সবাই আসলে নিজগল্পের কারিগর।
আমাদের মধ্যে হয়তো কারো বাবা, কারো চাচা বা মামা বিদেশে এসেছেন জীবিকার তাগিদে। আর একটু কিছুটা নিজেকে সামলাতে সক্ষম হওয়ার পর, পরিবার কে নিয়ে আসেন প্রবাসে। এখান থেকে শুরু আমাদের গল্প – নতুন প্রজন্মের গল্প। পরবাস প্রজন্মকথা এখান থেকেই।
-
এ প্রজন্মের কারো জন্ম বিদেশে কারো বা দেশের মাটি তে। কিন্তু দেশ কী বুঝে উঠার আগেই, পরদেশে নিয়ে আসা হয়েছে। আশপাশে কেউ ‘আমাদের’ মিষ্টি ভাষায় কথা বলে নাই সে সময়ে যে সময়টায় প্রতিবেশ আর পরিবেশ আমার নিজের কথা বলবে তখন। মা-বাবার মুখে শুনতে-শুনতে শেখা আমার বুলি। মা হাত ধরে ‘অ-আ’ শেখাতে গেলে তখন কিন্তু এ-বি-সি পড়ার জেদ ধরে বসতাম। আর এ-বি-সি শিখে আসতেই অ-আ তে ফেরার সময় ছিলো না। কত শত মার যে খেয়েছি বাংলা শিখতে গিয়ে। আজ সেই মারের জন্যে আমার মাকে ধন্যবাদ যিনি হাজার ব্যস্ততার মাঝেও ভাষা ভুলতে দেন নি আমাদের। মা বাবার মতো বাংলা বর্ণমালা আপন হয়েছিলো শৈশবে। আর তা হয়েছে মায়ের জন্য। কারণ আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে বাংলা ছিলো না। শুধু আরব আমিরাত নয় পৃথিবীর নানাদেশে এমন স্কুল আছে যেখানে বাংলা নেই। তাই আমরা নতুনেরা বাংলা শেখা থেকে বঞ্চিত হই। সে জন্য পরিবার থেকে এ শিক্ষার আন্তরিক উদ্যোগ নিলে যে কেউ শিখতে পারে। যেমনটি আমি শিখেছি।
স্কুলে গিয়ে আবার অবাক। এত মার খেয়ে বাংলা ভাষা শেখার কি লাভ হলো? ঘরে এসে জোরে জন-গন-মন গাইলে, মা জিজ্ঞেস করতেন, আমার সোনার বাংলা জানিস? তারপর নিজেই মা গুনগুনিয়ে কোনরকমে সুরে আমাদের জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাতেন। মা গান গাইতে জানেন না। কিন্তু সে কী মাধুর্য, কেমনে যে বুঝাই। মাতৃভাষার অমৃতরস যেন ভাসছে মাতৃকণ্ঠে। সেই বয়সে জাতীয় সংগীতের কথা গুলো বুঝতেই পারতাম না। আমের বন, বনের ঘ্রাণ, ভরা ক্ষেতের হাসি, মলিন বদন, সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেলেও চোখে জল আসতো ঠিকই, যেমন ঘুমোতে গেলে মায়ের কণ্ঠে কাজলা দিদি শুনে কান্না আসতো। কিছু না বুঝলেও, কাজলা দিদিকে না চিনলেও, উনার না আসার দুঃখে মনটা কেমন জানি করতো। যেমনটা অনেক রূপপুরের গল্প পড়ে আমাদের হয়। হায়রে আমার হারানো শৈশব।
এসবের মাঝে সময় ঠিক নিজ গতিতে চলতে থাকে। বাংলাদেশী কমিউনিটি বলে যে কিছু একটা আছে, এমন অনেক পরিবার খুঁজে পাবেন আমাদের মতো, যারা এসব জানেনই না। তার মানে দেশীয় ছোঁয়ার খুব বাইরে। ভারতের ইতিহাস, ভারতের কাহিনী, ভারতের বিজয় গাথা পড়েও কেউ ভারতের নাগরিক ভেবে ভুল করলে চট করে উত্তর দিতাম – ‘আমি গর্বিত বাংলাদেশি’।
দেশ থেকে অনেক দূরে থাকি। সাত সাগর আর তেরো নদী দূরে। দেশে যাওয়াও হয় খুব কম। কিন্তু দেশ যে পরম আপন মাতৃতুল্য, পূজনীয় তা যে অনুভব আসে তা বুঝাবার কোন ভেজ্ঞানিক যন্ত্র নেই। হয়তো এই অনুভব সবাই পায় না কেউ কেউ পায়।
-
বিদেশে থাকার ব্যাপারটা মজার হলেও, দেশ থেকে দূরে থাকাটা সবার জন্যে সহজ না। আমাদেরও ক্ষেত বা কাদায় লুটেপুটে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়, দেশের বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হয়, স্কুলে সকালে দলবেঁধে আমার সোনার বাংলা গাওয়ার ইচ্ছে হয়। আমাদের ইচ্ছে হয় প্রভাত ফেরিতে থাকার, বৈশাখ থেকে চৈত্র, ১২ মাসে ১৩ পার্বনে মেতে থাকার। ইচ্ছে হয় বাংলাদেশের রূপবৈচিত্রে পতেঙ্গা হতে। আর জোর গলায় বলতে – ‘ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই দেখিতে চাইনা পৃথিবীর মুখ’।
বিদেশে বিদেশী হয়ে গেলে ব্যাপারটা খুব মজার কিন্তু বিদেশে এসেও দেশ না ভুললে খুব কষ্ট হয়। হলফ করে বলতে পারবো এমন অনেক পরিবার আছে যারা পরবাসেও দেশ কে ধরে রেখেছে। নিজেরা ব্যবস্তার পরেও দেমিয় সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেন। ছেলে মেয়েদের বাংলার সংস্পর্শে নিয়ে আসেন।
সব বড়দের কাছে একটাই অনুরোধ, বাচ্চাদের ভাষা শেখান, দেশ বোঝান। আজ বুঝলে, কাল বোঝাবে। দেশ ও দেশপ্রেম বাঁচবে এমন ভাবেই। কখনো আপনার বা কখনো আমার মনে। দেশের মজা ও দেশ কে পেতে চাই ঠিক একই ভাবে বিদেশে।
দেশপ্রেম, ভাষা, সংস্কৃতি তুলে দিন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। ধন-সম্পত্তি আজ আছে কাল নেই, এই দেশ ও মাটি চিরকাল যেন আমাদের করে রাখতে পারি, এমন শিক্ষা দেয়ার অনুরোধ আপনাদের কাছে। আর আপনাদের বুঝিয়ে দেয়া দেশ যেন আমরা এভাবেই ধরে রাখতে পারি এটুকুই প্রার্থনা ইশ্বরের কাছে।
ইতি,
নতুন প্রজন্ম