ড. আতিউর রহমান:
হালে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়নের কথা দেশি-বিদেশি অনেক অর্থনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শুনেছি। বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কৌসিক বসু গত বছরের মে মাসে ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’-এ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কেন এমন তরতর করে এগোচ্ছে?’ ইংরেজিতে বুমিং শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। এরপর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘ, এডিবি, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন উপাখ্যানকেই এশিয়ার তথা বিশ্বের সেরা বলতে দ্বিধা করেনি। বিশ্বখ্যাত রেটিং এজেন্সিগুলোও বাংলাদেশকে ইতিবাচক রেটিং করছে। সারা বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারীর চোখ এখন বাংলাদেশের ওপর। তাঁরা প্রায়ই আমার মতামত নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন। তাই বুঝতে পারি তাঁদের আগ্রহের দিকটি।
সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধির গতি যখন শ্লথ, আগামী বছর নাগাদ আরেকটি বিশ্ব আর্থিক মন্দা আঘাত হানতে পারে বলে জাতিসংঘ যখন আশঙ্কা প্রকাশ করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প বেশ জোরেশোরেই বলা হচ্ছে। আমরা দেশের ভেতরে নিজ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিস্ময়কর রূপান্তর অনেক আগে থেকে বললেও বিদেশিদের মুখ থেকে দেশের সাফল্য ও সম্ভাবনার কথা ইদানীং বেশ শুনছি। আর এসব আশাজাগানিয়া কথা শুনলে কার না ভালো লাগে। আরো ভালো লাগে এসব আশাবাদকে সুসংহত করে অত্যন্ত ‘স্মার্টলি’ যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশের ফোরামে উপস্থাপন করেন। তখন এই অর্জন এক নতুন মাত্রা পায়। কেননা তিনি এ কথাটি বলেন হৃদয় থেকে। আপন অভিজ্ঞতা থেকে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সময় নানা ফোরামে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের সাফল্যের কথা বলেছেন। এর কয়েক দিন পরেই দিল্লিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভারতীয় সামিটে তিনি আরো সুন্দর ও সংহত করে বাংলাদেশের উন্নতির গল্পটি বলেছেন। আর বলেছেন এর পেছনের কারণের কথা। বলেছেন এই গল্পের ভিত্তির কথা। এর প্রতি আস্থার কথা। বিশেষ করে দিল্লিতে অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সংক্ষেপে তাঁর কথাগুলো উপস্থাপন করলে এমন দাঁড়ায় :
এক. বাংলাদেশের মানুষের উদার সামাজিক মূল্যবোধ ও বাংলাদেশের চেতনায় তাদের আস্থা।
দুই. সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে গভীর আকাঙ্ক্ষা, তাদের সহনশীলতা এবং নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা।
তিন. বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত ও ন্যায়পরায়ণ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আমাদের উন্নত দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে চলেছে।
চার. পোশাক উৎপাদনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ উদ্ভাবনী চেতনা আর প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে ঝুঁকি নিচ্ছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।
পাঁচ. বাংলাদেশের তারুণ্যদীপ্ত জনগোষ্ঠীর উদ্যম, ডিজিটাল দক্ষতা, দ্রুত নগরায়ণের আবহে এক নয়া সমাজ বাস্তবতার ইঙ্গিত করছে। এদের মধ্য থেকেই ২০৩০ সাল নাগাদ তিন কোটি মধ্যবিত্ত অগ্রসর ভোক্তা শ্রেণির উদ্ভব ঘটবে। নিঃসন্দেহে বিনিয়োগকারীদের জন্য এক বিশাল বাজার অপেক্ষা করছে।
ছয়. বাংলাদেশ কিভাবে ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করে থাকে সেদিকটিও বিনিয়োগকারীদের তিনি আশ্বস্ত করেন। একই সঙ্গে এত সব ঝুঁকি সত্ত্বেও কী করে একটি দেশ বর্তমানে ৮.১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, সে কথাটি মনে করিয়ে দেন। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট অর্থনীতির আকার কী করে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর মাপে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে পঞ্চম বৃহত্তম দেশে পরিণত হয়েছে, ডিজিটাল লেনদেন প্রসারের ফলে দ্রুত মুদ্রাবিহীন দেশে পরিণত হচ্ছে, ই-কমার্স লেনদেন ২৬ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, ছয় লক্ষাধিক আউটসোর্সিং নিজ উদ্যোক্তা নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা গেছে এবং ভারত-চীন-আসিয়ান গতিময় প্রবৃদ্ধির ত্রিভুজের মধ্যমণি হতে পেরেছে। বাংলাদেশ এসব কারণেই নিজেদের ১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের বাইরেও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাণিজ্য যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হওয়ার দাবি রাখে।