চলুন ‘কঠিনেরে ভালোবাসি’
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৫৮:৫০,অপরাহ্ন ২৯ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ৬৩৪ বার পঠিত
নিউইয়র্কের রাস্তাগুলো এই দিনগুলোতে ভুতে ভরা। বাইরে এখন রোদনভরা বসন্ত। কেবল সাইরেনরা নীরবতা ছিন্ন করে। কোভিড-১৯ মহামারিটি কেটে গেলে কিছু পরিচিত মুখ ফিরে আসবে; অনেকেই আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
একটি সংখ্যাই আমাদের অসাড় করে দিতে পারে। নিউইয়র্ক সিটিতে এখন বিগত বছরের মৃত্যুর চেয়ে একদিনেই অনেক বেশি মৃত্যু হয়েছে। আজ অবধি আমরা ৯/১১–এর সময়ে নগরীর মৃতের সংখ্যার চেয়ে চারগুণ বেশি লোককে হারিয়েছি। এই সংখ্যাগুলোর অবশ্যই নাম রয়েছে। তারা এমন পরিবারগুলোকে রেখে গেছে, যারা তাদের শোক করছে এবং তাদের গল্প আরও অনেক দিন বলে যাবে।
সেই গল্পগুলোর মধ্যে একটি মোহাম্মদ জাফরের। তিনি ছিলেন অভিবাসী এবং তিন সন্তানের বাবা। তিনি তাঁদের বাচ্চাদের এ দেশে সর্বোত্তম শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য হলুদ ক্যাব চালাতেন। আমেরিকান ড্রিম—ট্রাম্প থেকে শুরু করে আপনার পরিবার ও আমার, প্রতিটি অভিবাসীর গল্প এটি। বিবরণ বদলালেও মূল গল্প একই। সবাই এখানে আসে সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একটি উন্নত জীবন গড়ার আশায়। এখানে জন্ম নেওয়া আমেরিকানদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অবদান বেশি। ব্রঙ্কসের গানহিল রোডের কাছে একটি অ্যাপার্টমেন্টে তিন সন্তানকে এতিম করে চলে গেলেন মোহাম্মদ জাফর। তবে তাঁর এ গল্প শুধু ট্র্যাজেডি নয়, একটি বিজয়গাথাও। তিনি এর শুরু করেছিলেন, শেষ দেখে যেতে পারলেন না। নিউইয়র্কে থাকলে আপনি দেখতেন যে, এখানে অনেকেই হলুদ ক্যাব চালিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেন। জাফরও অভিবাসী হয়ে এসে ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন ডেলিভারিম্যান। তিনি একজন ক্যাবচালক ছিলেন। তবে তিনি সর্বদা এটি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, এখানে ও বাংলাদেশে তাঁর পরিবার স্বচ্ছন্দ্যে থাকবে। এ জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ জাফরের আমেরিকান গল্পের শুরু ১৯৯১ সালে। তিনি যখন বাংলাদেশ থেকে আসেন, তখন থেকেই তিনি কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে অন্য অভিবাসীদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতেন। তিনি তাঁর অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন, যা তিনি দেশে তাঁর বাবা–ময়ের কাছে পাঠাতেন। তারপর তিনি বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করলেন। প্রথম সন্তান মাহবুব রবিনের জন্মের পর তিনি নিউইয়র্ক ফিরে আসেন। ২০০০ সালে আরেক সন্তান মাহতাব শিহাবের জন্ম হয় এলমহার্স্ট হাসপাতালে, যেটি বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারির গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে পরিচিত।
জাফরের স্বপ্ন ছিল, তাঁর সন্তানেরা পড়ালেখার সবচেয়ে সেরা সুয়োগটি যেন পায়। মাহতাব বলেছিলেন, ‘তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন আমরা যেন পড়াশোনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেরা সুযোগ পাই। আমরা এসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।’
বাচ্চাদের লেখাপড়া ব্রঙ্কসের পিএস ৯৫–এ শুরু হয়েছিল। তবে মোহাম্মদ জাফর প্রেপ ফর প্রেপ নামে একটি অলাভজনক নিয়োগ প্রোগ্রামের কথা শুনেছিলেন, যা নিউইয়র্ক সিটির নিম্ন আয়ের বাচ্চাদের ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। মাহতাব ট্রিনিটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে যাওয়া শুরু করেন। সহপাঠী উইল ক্র্যামার তাঁর নিকটতম বন্ধু এবং একটি বিতর্ক ক্লাবের সঙ্গী । তিনি মাহতাবকে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সবার মধ্যে সুন্দর ও খুব দয়াবান’ শব্দগুলো ব্যবহার করেন। মাহমতাব সম্পর্কে ক্র্যামার বলেন, ‘সম্ভবত কিছুটা রক্ষণশীল ধরনের। তবে একবার আপনি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বুঝবেন যে, সে কতটা বন্ধুবৎসল, মজার ও ক্যারিশম্যাটিক।’
২০১৬ সালে তাদের পরিবারে ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটে। ওই বছর মাহমুদা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পরের বছর যখন মাহতাবের হার্ভার্ডে সুযোগ হয়েছিল, তখন তাঁর ছোট বোন ট্রিনিটিতে কিন্ডারগার্টেন শুরু করেছিলেন। পিতা তার সন্তানকে স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় দেখে খুব খুশি হন।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরও ভেঙে পড়েননি জাফর। তখনো জাফর মেয়ে সাবিহাকে ম্যানহাটনের কাছে ট্রিনিটি স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজের কর্মদিবস শুরু করতেন। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। কঠোর পরিশ্রমে সুফলও মিলছিল। সাবিহাও ভাইদের মতো পড়াশোনায় ভালো করছিল। সে এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও ইতিহাস—দুটি প্রধান বিষয় নিয়ে পড়ছে। মাহতাব শিহাব ফোনে বলেছিলেন, ‘বাবার কোনো ধরনের চাকরি ছিল না। কোনো সম্পদও ছিল না। তিনি তাঁর সন্তানদের সুশিক্ষিত করে সম্পদে রূপান্তরিত করেন।’
মার্চ মাসে হার্ভার্ড বন্ধ হয়ে যায় এবং মাহতাব বাসায় আসে। তাঁর বাবা ইতিমধ্যে সেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। সে সময় তাঁর ক্যাবচালনার কাজটি নিরাপদ কিনা, তাই নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। কিছু দিন সামান্য জ্বর নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। তার পরপরই তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেন তিনি। তাঁর বাচ্চারা তাঁকে মন্টিফোর মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়, যেখানে তাঁকে এক সপ্তাহের জন্য ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছিল। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে যখন মনে হচ্ছিল, তার পরপরই তিনি মারা যান।
মোহাম্মদ জাফরের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। কথাটি দ্রুত ছড়িয়ে গেল। মাহতাবের বন্ধুরা ভয়াবহ খবরটি শুনে পরিবারের সাহায্যের জন্য ছুটে এল। উইল ক্র্যামার একটি ‘গোফান্ডমি’ প্রচার শুরু করতে সহায়তা করেছিল। মাহতাব বলেছিলেন, প্রতিটি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অনুদান এসেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা আর্থিকভাবে খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ব।’
কয়েক দিনের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার জোগাড় হয়। এটি ছিল এক লাইফলাইন, যা মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারে। আদতে সংকটের সময়ই আমরা সর্বোত্তমভাবে একত্রিত হই। এমনকি বেঁচে থাকার জন্য যখন আমাদের আলাদা থাকতে হয়, তখনও। পৃথিবীতে বাবা ও মায়ের বিকল্প নেই। তবে এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় সত্য ও স্বস্তির কথা যে, মোহাম্মদ জাফরের সন্তানেরা এতিম হলেও একা নয়।
মাহতাব আমাকে শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাবা নিজের পরিশ্রমের ফল সত্যই কখনো দেখতে পেলেন না।’
তবে সত্য যত কঠিনই হোক, তাকে মেনে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি আমাদের রয়েছে। আমেরিকায় আমাদের অভিবাসী পরিবারগুলো বারবার এটি প্রমাণ করেছি এবং আমরা আবারও করব। মৃত্যুর সংখ্যা এখনও বাড়ছে। এই সংখ্যা এক দিন থামবে। অর্থনীতি আবার দাঁড়িয়ে যাবে, তবে ধীরে ধীরে। আমরা যে লোকদের হারিয়েছি তারা ফিরে আসবে না। মোহাম্মদ জাফরদের মতো অনেকেই আর ফিরবেন না। কিন্তু এই মৃত্যুই জাগিয়ে দিচ্ছে দিকে দিকে মানবিকতার মশাল। সত্যকে মেনে নিয়ে এই মশাল হাতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে।