- অভিবাসন
- আমার বাবার চিঠি
আমার বাবার চিঠি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৬:৩৯,অপরাহ্ন ১০ ডিসেম্বর ২০২১ | সংবাদটি ২৭০ বার পঠিত
জান্নাতুল ফেরদৌসী মেহমুদ
সময়টা ছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ। আমার বাবা তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে জব করতেন। বিয়ে-শাদী করবেন ভেবে, কয়েক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিলেন পূর্বপাকিস্তানে (বাংলাদেশে)। আত্মীয়-স্বজন মুরুব্বীরা সবাই মিলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার বাবার বিয়ের পাত্রী খোঁজার কাজে। এক মাসের ব্যবধানে পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেল। এবং বিয়ের দিন ধার্য করা হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের ৫ই জানুয়ারি আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়। আমার বাবা এবং চাচারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন বলে, আমাদের গ্রামে আমার দাদার বাড়ি এক নামে বেশ সুপরিচিত ছিল। তার ওপর বিদেশফেরত উচ্চ শিক্ষিত, চাকরিজীবি, সুদর্শন যুবকের কাছে আশেপাশের গ্রামের সবাই তাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন এবং মরিয়া হয়ে ওঠে। অপরপক্ষে সেই গ্রামে, আমার নানা ভাইয়ের বেশ নামডাক ছিল তার প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য। অন্যান্য বেশকিছু ভালো প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও , আমার দাদা আমার নানা ভাইয়ের পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন। আমার নানাভাইও আমার বাবাকে মেয়ের জামাই হিসেবে বেশ পছন্দ করেছেন। এবং অনেক শখ করে তার কাছে নিজের আদরের মেয়েটিকে তুলে দিয়েছেন। দেখতে দেখতেই বিয়ের পর দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। মার্চ মাসে ইসলামাবাদের অফিস থেকে, ছুটি শেষে অফিসে ফিরে যাওয়ার টিকেট ও বেতন পাঠিয়ে দিয়েছে এবং বলেছে যদি স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায়, নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে গেলে তারা টিকিটের খরচ পরিশোধ করে দিবে। বাবা তখন দাদিকে জিজ্ঞেস করলে আমার দাদি বলেন, – “বাবা আমি অনেক শখ করে বৌমাকে ঘরে এনেছি । এত তাড়াতাড়ি আমি তাকে একা বিদেশে যেতে দিতে চাইনা। আমার সাথে রেখে, আমি তাকে একটু ঘর গৃহস্থালী শেখাতে চাই। তাকে আদর যত্ন ভালোবাসা দিতে চাই। তার কাছে থেকে আদর যত্ন পেতে চাই।” তখন বাবা বললেন, – “এখন নিয়ে না গেলে আমি তিন মাসের আগে আসতে পারবো না ।” আমার দাদি বললেন, – “ঠিক আছে তুমি তিন মাস পরে আসলে তখন বৌমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেও । আমার তখন কোনো আপত্তি থাকবেনা ।” যেই কথা সেই কাজ । মার্চ মাসে বাবা প্রস্তুত হয়ে গ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে গেলেন । ৭ তারিখে ঢাকা থেকে তাঁর ফ্লাইট ছিল ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে। মার্চ মাসের ৭ তারিখে ইসলামাবাদ পৌঁছে, আমার বাবা চিঠি পাঠানোর কথা ছিল, ঠিকমত পৌঁছিয়েছে বলে। কিন্তু ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর। দুই দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তখন ডাক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে, কয়েক মাস কেটে গেল । কিন্তু সেই চিঠি আমার দাদার বাড়িতে আর এসে পৌঁছায়নি। সেই সময়ই আমার বাবার এক বন্ধুর ভাই থাকতেন আমেরিকাতে। তখন আমার বাবা তাঁর বন্ধুকে চিঠি দিয়েছেন যেটা তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে আমেরিকাতে পাঠানোর পর, আমেরিকা থেকে তাঁর ভাই আমার দাদার বাড়ির ঠিকানায় বাংলাদেশ পাঠায়। সেই চিঠি পেয়ে সবাই জানতে পারে, আমার বাবা পাকিস্তানে আটক অবস্থায় আছে। তারপরে আবারো আরো কযেকমাস কেটে যায় কোনো খোঁজখবর ছাড়া। বাবার জন্য আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি আর মা সবাই চিন্তায় উদ্বিগ্ন। কি অবস্থায় আছেন, কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছে কিনা ? ততদিনে পাকিস্তানি মিলিটারি মোটামুটি সারা বাংলাদেশের উপর কব্জা করে নিয়ে, শুরু করেছে গণহত্যা অত্যাচার আর নির্যাতন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যুবক ছেলেদেরকে খুঁজে আটক করে নিয়ে যেত, আমার বাবাকেও খুঁজতে এসেছে বেশ কয়েকবার। যে সময়টাতে আমার বাবাকে নিয়ে আমার দাদার এবং নানার দু’পরিবারের জন্য খুবই আকস্মিক এক যুদ্ধের জঘন্য ভয়াবহতা কাজ করছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে। পাড়া-প্রতিবেশী এবং সমাজের মানুষ দুই পক্ষকেই আজেবাজে কথা বলে কান ভারি করতো। যেমন আমার নানা ভাইকে এসে বলতো, – “আপনার মেয়েকে এখনো কেনো সেখানে রেখেছেন? আপনার মেয়ের জামাই পাকিস্তানে আটক আছে । এ কয়েক মাসে বেঁচে আছে কিনা সেটার কোনো ঠিক নেই, মেয়েকে সেখানে এভাবে আটকে না রেখে বিয়ে দিয়ে দিলেই পারেন।” সেই একই মানুষগুলো আবার আমার দাদাকে গিয়ে বলতো, – “আপনার ছেলে কখন আসবে না আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপনার বেয়াই মনেহয় তার মেয়েকে এখানে এভাবে আর রাখবে না, তারা হয়তো তাদের মেয়েকে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দিবে।” আমার মা বলেছেন, – “যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, অন্য দেশে আটকে থাকা স্বামীর কোনো খবর না পেয়ে যে যন্ত্রণায় ভুগেছে তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে পাড়া-প্রতিবেশী আর সমাজের লোক।” সবচেয়ে বেশি শোচনীয় ব্যাপার হলো, আজ ৫০ বছর পরেও আমাদের সমাজের এই চর্চা চলছে, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস। এখন পর্যন্ত আমাদের সমাজের কোনো পরিবর্তন আসেনি । মিথ্যা এবং বানোয়াট যে কোনো কথায় যে কোনো মানুষ খুব সহজেই বিচলিত হতে পারে। মানুষের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আন্তরিকতা ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। একদিকে আমার দাদা ছেলের কোন খোঁজ খবর পাচ্ছিল না । অপরদিকে আশেপাশের মানুষের সব কথা তাঁকে অনেক দুঃখিত করে। সে অনেক হতাশাগ্রস্ত হয়ে আমার নানা ভাইয়ের কাছে এসে হাজির হয় এবং কাঁদতে কাঁদতে বলে,- “বেয়াই সাহেব, আমিতো অনেক শখ করে আপনার সাথে সম্বন্ধ করেছিলাম। আজকে প্রায় নয় মাস হতে চলেছে, আমার ছেলের কোন খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আমি নিজেই কত হতাশাগ্রস্ত এবং দুঃখিত সেটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। সবাই বলছে আপনি নাকি আপনার মেয়েকে নিয়ে নিবেন। আমার ছেলে ফিরে আসলে তখন আমি তাকে কি জবাব দিবো!” তখন আমার দাদাকে সান্ত্বনা দিয়ে আমার নানা ভাই বললেন, – “বেয়াই সাহেব, আপনি মন খারাপ করবেন না, আমি আপনার ছেলের কাছে আমার মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, যতদিন পর্যন্ত আমার মেয়ের জামাই ফিরে না আসে, আমি ততদিন অপেক্ষা করবো।” ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমার বাবার বিপদ এবার আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতদিন ছিলেন আটক, এখন থাকতে হবে পলাতক। তাঁর কাছে তখন দুটি বিকল্প উপায় ছিল। একটি হচ্ছে যদি পাকিস্তানে থেকে যেতে চান, তাহলে তাঁর চাকরি, বাসস্থান সহ অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা সহকারে সেখানে থেকে যেতে পারেন। আর যদি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চায়, সে পলাতক অবস্থায় থেকে, পালিয়ে সেখান থেকে দেশে ফিরতে হবে।
বাবার বেশ কিছু কলিগ এবং বন্ধুসহ আরো অনেক বাঙালি সেখানে আটক অবস্থায় ছিলেন। তারা অনেক চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করছিলেন, কিভাবে সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা যায়। এভাবে প্রথমে আট জনের একটা গ্রুপ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। সেই পথটা ছিল প্রথমে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে হবে আফগানিস্তান! আফগানিস্তান পৌঁছানোর পর কাবুলে যেয়ে পৌঁছাতে হবে। আমার বাবাদের প্রথম গ্রুপটা কাবুল গিয়ে পৌঁছার পর। পাকিস্তানের বাবার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, যে এতো দুর্বিষহ কষ্টের যাত্রা না করার জন্য। যেখানে ছিল প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি। জীবনের জন্য যদি মায়া থাকে পাকিস্থানে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার বাবা ততদিনে মনস্থির করে ফেলেছে, যেভাবেই হোক তাঁকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমার বাবা তাদের আট জনের একটা গ্রুপের সাথে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান যায় । পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের কাবুলে পৌঁছানোর পথে কিন্তু কোনো ট্রেন বা প্লেন ছিল না। সেই যাত্রাটায় ছিল রাতের গভীর অন্ধকার, আর তীব্র শীতের মধ্যে কিছুদূর হেঁটে, কিছুদূর বাসে, কিছুদূর গাড়িতে, কিছুদূর ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে, কিছুদূর দুর্গম পাহাড়ের উটের পিঠে চড়ে। যে যাত্রায় প্রতিমুহূর্তে গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার ভয় ছিল। এই দুর্বিসহ কষ্টের যাত্রা প্রায় ২০ দিনের মতো সময় লেগেছে। কাবুল পৌঁছানোর পরে, সেখানে ছিল ইন্ডিয়ান এম্বাসি। যেখানে বাংলাদেশীদের জন্য শরণার্থী শিবির ছিল। পরে কাবুল থেকে ফ্লাইট করে সবাইকে ইন্ডিয়ার দিল্লীতে পাঠানো হয়েছে। দিল্লিতে এসে পৌঁছানোর পর আমার বাবা দেশে চিঠি পাঠায় যে “আমি ইন্ডিয়ার দিল্লিতে এসে পৌঁছিয়েছি এবং নিরাপদে আছি।” পরে দিল্লি থেকে ফ্লাইট করে ঢাকাতে পাঠানো হয়েছে। আমার বাবা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার প্রায় একমাস পর বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। ঢাকাতে এসে সচিবালয়ে জয়েন করে, এক সপ্তাহ কাজ করার পর ছুটি নিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। আমার বাবা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তান গিয়েছিলেন। তিন মাস পরে ফিরে এসে আমার মাকে নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু দুই দেশের যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে, প্রায় দেড় বছর পর ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দেশে ফিরে এসেছিলেন। তারপর আমার বাবা-মা প্রায় ৩৬ বছর একসাথে সংসার করার পর, গত এক যুগ হলো বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। বাবা আজ আর আমাদের মাঝে নেই, আছে শুধু বাবার স্মৃতি আর আমার বাবার চিঠি। |