বই হোক নিত্য প্রহরী
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৫৫:০৬,অপরাহ্ন ১০ জানুয়ারি ২০২২ | সংবাদটি ১০৪ বার পঠিত
নূরজাহান শিল্পী
“ভাল বন্ধু, ভাল বই এবং একটি শান্ত বিবেক: এটি আদর্শ জীবন।” মার্ক টোয়েন এর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই বলি, একজন মানুষের মনের ভেতরের অন্ধকারকে জ্ঞানের আলোয় দূর করার জন্য একটি বই যে বিরাট ভূমিকা রাখে তা পৃথিবীর অন্য কোন কিছুই রাখতে পারে না। একজন মানুষ নিজে যখন জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ হয় তখন সে একটি দেশ কাল সীমানা অতিক্রম করে মানুষে- মানুষে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারে তার জ্ঞানের আলো।
আমাদের সেই জ্ঞান, আলোকিত জীবন, উন্নত চিন্তা চেতনায় এখন ভাটা পড়ছে। আমরা ইন্টারনেটের বদৌলতে আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলছি। বই পড়া, পাঠাগারে যাওয়ার অভ্যাসগুলো ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষত: তরুন প্রজন্মের মধ্যে মোবাইলে তথা ইন্টারনেটে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত হচ্ছে। অতীতে যে সময়টুকু বই পড়ার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বইয়ের রূপ, রস ও ঘ্রান সবমিলিয়ে জ্ঞান পিপাসায় ব্যতিব্যস্ত সময় পার হয়েছে। বর্তমানে সেটুকুও বিলীন হতে বসেছে। আমাদের মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তিগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের জন্য এই বার্তাটি সুখকর নয়।
প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করার মধ্যদিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে নিয়ে আসছে। সার্বিকভাবেই আমাদের এই প্রজন্মের অভাবনীয় ক্ষতি বয়ে আনছে। ক্ষতির এই পরিমাণটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসেব করলে তা হবে অনেক দীর্ঘস্থায়ী। শুধু চোখের ক্ষতিই নয়, আর্থিক ও সময়ের ক্ষতিটুকুও কম নয়। সেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে খেলাধুলা, বইপড়া, সকালে চায়ের কাপ হাতে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। ইট দালানের শহরে যাদের বসবাস তাদের জন্য এটি আরও দু:খজনক। ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করার অভাবনীয় যে ক্ষতি, সেটি হয়তো আমাদের ভবিষ্যত বলে দেবে।
সত্ত্বর, আশি ও নব্বই দশক বা তারও আগেকার সময়টা ছিল বই পড়ার দশক। আমাদের বিজ্ঞজনেরা বিশেষত: মা-বাবা, নানী-দাদীরা, তারপর আমাদের ৮০ দশকের যারা নির্ভেজাল বিনোদন কিংবা অবসর যাপনের মাধ্যম ছিল একমাত্র বই পড়া, অলস দুপুর বিছানায় বই হাতে গাঁ এলিয়ে দেয়ার অভ্যাসটুকু অনেকেরই ছিল। বর্তমান সময়ে সেসব চিত্র খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। অথচ নিত্য সঙ্গী বই আমাদের উজ্জীবিত করে তুলতো। নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যেতো। বই পড়ার মধ্যে যে আনন্দ ও তৃপ্তি সেটি বোঝবার ক্ষমতাটুকুও ইন্টারনেট বিলীন করে দিচ্ছে। সবার আগে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য মানবিক গুণাবলী তৈরি করতে হবে। প্রতিবেশি ও অন্যের উপকার করার মতো মনমানসিকতা থাকতে হবে। উন্নত চিন্তা-চেতনায় বিকশিত হওয়ার জন্য জ্ঞান আহরন, বই পড়াকে সঙ্গীয় রাখতে হবে।
এক যুগ আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সবুজ ঘাসে কিংবা চায়ের দোকানেও শিক্ষার্থীদের সাহিত্য আড্ডা বসত। ছাত্র সংগঠন ও সামাজিক অঙ্গনেও বই পড়ার প্রতিযোগিতা দেখা যেতো। আর সাহিত্যচর্চা হতো বই পড়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। জানার জন্য, শেখার জন্য, ছাত্ররাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য গ্রুপ ভিত্তিক পাঠাভ্যাস কিংবা সাহিত্যচর্চা ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার্থীদের আড্ডায় শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ তথা নানা বিষয় উঠে আসতো। জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হতো। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই মানুষের সকল জ্ঞান জমা রয়েছে বইয়ের ভেতরে। অন্তহীন জ্ঞানের মূল উৎসই হচ্ছে বই। আর বইয়ের আবাসস্থল হচ্ছে পাঠাগার। বই পড়লে যে কেউই হয়ে ওঠে আচরণে মার্জিত, চিন্তায় স্বত:স্ফুর্ত ও কর্মে দৃপ্ত। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বাস্তবতা ও কল্পনা বইয়ের মাধ্যমেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। অথচ ইন্টারনেট ভিত্তিক সেসব চিন্তা-চেতনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে ক্রমশ: বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সব আড্ডা ভাটা পড়েছে। ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটে মোবাইলে ব্যাপক আসক্ত হচ্ছে তরুন প্রজন্ম। একত্রে বসে খোশগল্প করার চেয়ে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার রেওয়াজ হয়ে পড়েছে। ফলে কমেছে বই পড়া, বইয়ের কদর, উপযোগিতা ও জ্ঞানস্পৃহা। পাঠাগার সমূহে হ্রাস পেয়েছে লোক সমাগম। সেসব স্থান দখলে নিয়েছে মোবাইল, টিভিসহ নানা ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রে। শিক্ষিত তরুণ সমাজের দিবারাত্রির সঙ্গী এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্র।
অন্যদিকে মাদকাসক্তিও গ্রাস করছে। বর্তমান প্রজন্ম মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিজাতীয় সংস্কার আমাদের ওপর মারাত্মক ধরণের প্রভাব ফেলছে। যার মধ্যদিয়ে একটা প্রজন্ম ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অথচ একটি বই হতে পারে আত্মশিখনের শ্রেষ্ঠ সহায়ক, বিশ্বস্ত সঙ্গী। বিনোদন থেকে শিক্ষা, অন্ধকার থেকে আলো, অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতা দূর করতে বই-ই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে। একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবে সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। সে কথাই বলে গেছেন অস্কার ওয়াইল্ড।
বইয়ের গুরুত্ব নিয়ে মনিষীদের এসব অসংখ্য উদ্ধৃত্ত রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবস্থায়ও বই পড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ কিন্তু হাতছাড়া হয়নি। সময়কে ভাগ করে নিয়েই একটি ভালো বই নিত্য সঙ্গী হতে পারে। একাডেমিক বই পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। এর জ্ঞান হবে ব্যষ্টিক। আর পাঠ্য বইয়ের বাইরে নানা ধরনের বই পড়লে জ্ঞানের পরিধি হবে সামষ্টিক। সারাদিনের ব্যস্ততার মধ্যে থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হোক। প্রতিদিন এই সময়টা শুধু বই পড়ার জন্য নির্ধারিত থাকুক। দৈনিক একই সময়ে বই পড়লে আস্তে আস্তে আমরা বই পড়ার অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠবো।
জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। ভূগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে প্রান্তে, যুগ থেকে যুগান্তর, কাল থেকে কালোত্তীর্ণ এভাবে প্রতিটি মানুষ বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে তাদের চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত আমরা এক আলোকিত অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবী খুঁজে পাবো। যা আমাদের স্বপ্নে বিরাজমান। আবারো আমরা এই প্রজন্মের তরুণদের ভেতর বইয়ের প্রতি নেশার বীজ বপন করি। নিজেকে ভালো সর্বাত্মক ভাবে ভালো রাখতে আত্মার খোরাক সব থেকে নির্ভেজাল বন্ধু বইকে সঙ্গী করে নেয়ার কোন বিকল্প নেই।
কবি, গল্পকার / লন্ডন
নুরজহান শিল্পী