শাহজালাল বিমান বন্দরের বেসুরো গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৩৯:৪৭,অপরাহ্ন ০৭ এপ্রিল ২০২২ | সংবাদটি ২৮০ বার পঠিত
ইসতিয়াক রুপু
৩রা এপ্রিল ছিলো আমেরিকা ফিরে আসার ফিরতি যাত্রা।কাতার এয়ারওয়েজের প্রায় মধ্যরাতের ফ্লাইট।
সাধারন বিদেশগামী যাত্রীদের শতকরা ৯৫% ভাগের ভিতর নানা আতঙ্ক কাজ করে।এসবের অনেক কারনগুলির অন্যতম কারন, বিমান বন্দরে যাত্রী সেবার চরম অব্যবস্থা।বাকি ৫% শতাংশের এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা বা অভিযোগ নেই।যারা সরাসরি ভি আই পি টার্মিনাল ব্যবহার করে সরকারী বা বেসরকারী নয়তো নির্বাচনে (?) জেতা পদ পদবী ব্যবহার করে সোজা চলে আসেন আন্তর্জাতিক টার্মিনালে।তাদের যেহেতু ঝামেলা পোহাতে হয় না।তাই উনারা বেশির ভাগ সময় এই বিষয় নিয়ে কথাও বলতে চান না।তবে এ সব অব্যবস্থার বিষয় নিয়মিত বিমানবন্দর ব্যবহারকারীদের কারো অজানা নয়।আমি একজন আমেরিকান অভিবাসী।স্বভাবত আমার জন্য যেমন আমেরিকাতে কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই তেমনি বাংলাদেশে ও তেমন কোন বিশেষ সুযোগ বা সুবিধা থাকার কথা নয়।যা আমি আশাও করি না।আমেরিকা থেকে কাতার এয়ার ওয়েজের বিশাল আকারের বিমানে চড়েছি নিউইয়র্কস্থ জে এফ কে বিমান বন্দরের ৮ নং টার্মিনাল থেকে।উল্লেখিত টার্মিনালে কমপক্ষে ১০ টি ( কম বেশি হতে পারে) এয়ার লাইন্সের কয়েক হাজার যাত্রী সুশৃঙ্খল ভাবে, সাধারন যাত্রী ও ভি আই পি যাত্রী যার যার উপর জারিকৃত আইন ফলো উড়োজাহাজে চড়ার পূর্বে যাবতীয় কার্যাদি সেরে নিচ্ছেন নিয়ম মেনে।সবখানেই পরিবেশ ভীষন শান্ত।বিমানে সময় মত চড়ার তাড়া আছে বটে তবে কোন বাড়তি হৈ চৈ নেই। অথচ তার বিপরীতে ফিরতি যাত্রার প্রায় ৬ ঘন্টা পূর্বে দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল বিমান বন্দর অভিমুখে এসে আটকে গেলাম বহির্গমনের ( দ্বিতীয় তলা) উঠার ফ্লাই ওভারের মুখে।প্রচন্ড ভীড় পুরো মুখ জুড়ে।যেখানে দুটো লাইন হওয়ার কথা।প্রাইভেট কার, টেক্সি ও পিচ্চি সি এন জি সহ সবাই মিলে ইচ্ছে মত লাইন করেছে তিন তিনটি।যে যার মত ডানে বামে একে বেকে ঢুসাঢুসি করে বা চাপা দেবার ভয় দেখিয়ে রাস্তা করে নিচ্ছে ইচ্ছে মত।ফ্লাই ওভারের বেশ সামনে বিশেষ পোষাক পরে কাঁধে সেমি অটো বন্দুক হাতে তরুন পুলিশ বাহিনীর দুজন ঠায় দাড়িয়ে।উনাদের একমাত্র কাজ আগত গাড়ি গুলোকে চলতি অবস্থায় থামানো। কোন কারন না বলে বা কখনো চুপ থেকে চলমান গাড়ির জানালায় উঁকি দেয়া।হয়ে গেলো। কাজ শেষ।ছেড়ে দেয়া কার টেক্সি বা সি এন জি কোথায় গেলো বা নিয়ম মেনে কোন পাশে দাড়ালো বা ঠেলা ধাক্কা শুরু করলো কি না তা আর দেখার সময় উনাদের নেই।ফ্লাই ওভারের মুখে শতভাগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দাড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর জটলায় জোর করে আরো কার ও সি এন জি যোগ দেয় ইচ্ছে মত।এর পর শুরু পায়ে পায়ে এগুনো।কখনো ডানে কখনো বামে, কখনো সি এন জি চালক কে ধমক দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে( ৪০/৪৫ মিনিট পর)পৌছা গেলো টার্মিনালে।ওখানে উঠবার মুখে আরেকদফা চেকিংয়ের নামে হয়রানী।টার্মিনালের প্রশস্থ সম্মুখ ভাগ শত শত কার, মাইক্রোবাস ও পিচ্চি সি এন জি এর জবর দখলে।কম বয়সী হাল্কা পাতলা শরীরে বিশেষ পোষাক পরিহিত বঙ্গসন্তানদের হুইসেল বাজানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই।বিশৃঙ্খল ভাবে ডান
ও বাম পাশ দখল করে রাখা কোন গাড়ির চালক এসব হুইসেল বলেন আর ধমক বলেন কিছুই শুনছে না।আর পুলিশ ভাইটি ও থামার পাত্র নয়।সে বিরাট পিলারের পাশে দাড়িয়ে বিরামহীন বাজিয়ে তুলছে সখের(?) হুইসেলে আওয়াজ।পি পি পি।অস্বাভাবিক অবস্থার কোন পরিবর্তন না হলেও প্রচুর শব্দ দূষনে কান পাতা দায়।শত শত নয় হাজার হাজার বিদেশ গামী যাত্রী বহির্গমন ভবনের প্রতিটি প্রবেশ পথে হুমড়ি খেয়ে কয়েকটি লাইন ( ইচ্ছে মত তৈরী করা) দিয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে।দরজায় বিশেষ পোশাক পরিহিত বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য, লিক লিকে শরীর নিয়ে বিশেষ বাহিনী।সবার একমাত্র কাজ প্রবেশ মুখে হুমড়ি খেয়ে পড়া যাত্রী সৃষ্ট জটলা কে ধাক্কা দিয়ে সরানো।আরেকটি বিশেষ কাজ সাবধানে চালানো।প্রতি যাত্রীর সঙ্গে আছেন কম পক্ষে তিন থেকে চারজন।তাদের কেউ যাত্রীর লাগেজ সামলাচ্ছেন কেউবা আবার ( যিনি চালাক ও চতুর) বাহিনীর ভাইদের ম্যানেজ করতে চেষ্টা করছেন।এরকম কম পক্ষে পাঁচটি প্রবেশ দ্বারে বিশাল বিশাল জটলা।আমি গাড়ি নিয়ে দাঁড়ালাম শেষ প্রান্তে। সঙ্গে আসা দুজন সাহায্যকারী চট জলদি দুটো সুটকেস নামানো মাত্র একজন হাতের কাছে পেয়ে গেলো সুটকেস বহনের ট্রলি।এখন আমার কাজ হলো সামনে কমপক্ষে তিনটি জটলা ঠেলে একদম শেষ গেটের মুখে যাওয়া।প্রথম জটলা নিরাপদে পেরুতে পারলে ও দ্বিতীয় জটলায় বাধা পড়লো জোরেসোর।অন্য ভাষার সহায়তা নিয়ে জোর গলায় ধমকের সাহায্যে পেরুতে হলো নিজেকে দেশের শক্তিমান বাহিনীর কেউকেটার ভাব ধরে।এসব স্থানে সব সারতে হবে অল্প আলাপে, ভিন্ন ভাষায়, বুলন্দ আওয়াজে। আমি এখন মূল গেটের মুখে।এবার দেখা গেলো বাহিনীর বিশেষ ব্যাক্তি কে।
চেহেরায় দেশি ছাপ তবে সাইজে পাঠান আকারের।মানে বেশ দশাসই। বেশ লম্বা চওড়া আকৃতির।হাতে আমেরিকান পাসপোর্ট উঁচু করে ধরে দ্রুত চলে যাই বিশাল শরীরের বঙ্গসন্তানের সামনে।ভিন্ন ভাষায় চোয়াল শক্ত করে বললাম, আমি বয়স্ক লোক। দুমিনিট দাড়াতে পারবো না। তুমি ডান পাশে সরে আমার লোকদের ভিতরে আসতে দাও।আর তা না হলে তোমাকে গেইট ছেড়ে আমার মালামাল কাতার এয়ার ওয়েজের ডেস্কে পৌঁছাতে হবে।দেখ তুমি কোনটি করবে? সময় কম।আমি জানি সে গেইট ছেড়ে যাবে না। বিমানবন্দরের বিশেষ গেইট আজ তারজন্য চেরাগ বাত্তি। ঘসা দিয়ে নোট খসাবে।তার চেয়ে আমার মত ঝামেলার কাউকে গেইট থেকে দুরে রাখার ভালো।তাই বুঝি ভিতরে থাকা আরো দুজনকে হুকুম দিতেই ওরা এসে যোগ দিলো আমাকে গেইট থেকে দুরে সরানোর মহৎ কর্মে। স্ক্যানার মেশিনে তোলা সহ ট্রলিতে দুটোর সুটকেস ফের তোলা হলো অসম্ভব দ্রুতগতিতে। ট্রলি নিয়ে সামনে এগুতে পারছি না।পুরো হলো জুড়ে যে যার মত ট্রলি নিয়ে শত শত যাত্রী অপেক্ষামান।ফ্লোর জুড়ে সব যাত্রীরা ট্রলি নিয়ে বসা অথবা দাড়ানো।ভাই সরেন, রাস্তা দিন এসব বলে কয়ে কোন ক্রমে পৌঁছলাম কাতার এয়ারওয়েজের ডেস্কে।বিজনেস ক্লাশে দাঁড়ানো একজন ভদ্রলোকের নিকট বিনীত ভাবে সহায়তা কামনা করতে না করতে ফল পেয়ে গেলাম দ্রুত। সমান সহায়তা পেয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন ডেস্কে। রেকর্ড পরিমান কম সময়ে আমি বিমানে উঠার প্রথম সারিতে বসে অন্য লোকের সহায়তায় আনা সদ্য তৈরী করা ধোঁয়া উঠা কফির মগে চুমুক দিতেই মনে পড়ে গেলো বাইরের হাজারো বঙ্গ সন্তানদের কথা।মনে মনে আন্দাজ করে দেখলাম প্রতিদিন দেশের এই বিমান বন্দর দিয়ে বৎসরে প্রায় ৬৪ লক্ষ (২০১৯ সালের হিসাব) যাত্রী আসা যাওয়া করেন। বর্তমানে সে পরিমান ৭০ লক্ষ ( যাওয়া আসা) হতে পারে।যদি অর্ধেক যাত্রী বিদেশ যান তবে সে পরিমান ৩৫/৩৬ লক্ষ হতে পারে।সে হিসাবে বিদেশ যেতে ইচ্ছুখ যাত্রীর প্রতিদিনের পরিমান মাত্র ১০ হাজারের মত।যারা কখনো এক সঙ্গে আসেন না।২৪ ঘন্টা জুড়েই আসার সময় নির্ধারিত থাকে।একসঙ্গে ( বিশেষ করে সন্ধা ৬ টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত) বেশি হলে ৩/৪ হাজার যাত্রী পুরো টার্মিনালে(ভিতর/ বাহির) অবস্থান করেন।মাত্র তিন/চার হাজার যাত্রীদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য শত শত বিশেষ পোষাকধারী ও কাঁধে রাইফেল নিয়ে দাড়াতে হবে না।উনাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাহারায় রাখুন যথাযত প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে। বিনোদনের ব্যবস্থা রাখুন। বাকি যাত্রীদের আগাম তথ্য নিয়ে নিদৃষ্ট সময় বেধে দিন।বর্তমানে বেশির ভাগ যাত্রী ভয়ে ৭/৮ ঘন্টা এমনকি ১২ ঘন্টা পূর্বে বিমানবন্দরে এসে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করে। নিচ তলায় যেখানে যাত্রী আগমন ভবনের সম্মুখে বিরাট একটি কার পার্কের মত খালি স্থান চোখে পড়লো। সেই খালি স্থান কে কাজে লাগানো যায় নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায়।প্রথমে সব ধরনের ছোট গাড়ি নিচে পার্ক করতে বাধ্য করা। যাত্রীর মালামাল ট্রলিতে নিয়ে ভবনের পাশে চলন্ত সিড়ি অথবা লিফট নিয়ে উপরের তলায় বহির্গমন ভবনে চলে যাবে।পুরো ব্যবস্থা সামান্য পরিমান ফি(টাকাঃ ২০০/৩০০) প্রদান করে স্মার্ট সাহায্যকারীদের সহায়তা নিতে পারেন অনায়াসে।কারন বিশেষ বাহিনীর ভায়েরা অনেক বেশি টাকা দাবী করেন ফাড়ি পথে অসহায় যাত্রীদের ভবনে ঢুকাতে।যা বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের বিলকুল জানা। আর এজন্যই বেশির ভাগ যাত্রী সাথের একজন কে লাইনে দাঁড় করিয়ে গেটের মুখে জটলা পাকায় দ্রুত সেবা সিস্টেমের আশায়।যখন যাত্রীগন সহজে কোন রূপ কৃথিম বাধা ছাড়া তার কাঙ্খিত ডেস্কে পৌঁছাতে পারবে, তখন সে কোন ভাবেই আর মুখে জটলা পাকাবে না কিম্বা সবাই পূর্বে এসে বিমানবন্দর কে পল্টনের জনসভায় রুপান্তরিত করবে না। যাত্রীর সেবা নিশ্চিত থাকলে পুরো বিমানবন্দর এলাকা সহ ভবনের বাহির ও ভিতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।কোন যাত্রী হৈ চৈ করতে সাহস ও করবে না। এখন প্রশ্ন হলো এই বিশাল ঝুট ঝামেলা (মানুষের সৃষ্ট) সরানোর দায়িত্ব কে নিবে। উত্তর সোজা।বর্তমানে শতভাগ সফলতা তা দেশে হউক আর বিদেশে হউক।যে বাহিনী করছেন মানে সেনা বাহিনীর সাহায্য নিতে হবে।শুরু উনাদের দিয়ে করা হউক।পরে বৎসর দুই পর যখন স্থায়ী সিস্টেমে চলে আসবে তখন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আর তা নিয়ে ভাবনার সময় কিন্তু দ্রুত সরে যাচ্ছে। যাদের কষ্টার্জিত মুদ্রায় দেশ চলছে তাদের কল্যানের কথা এখনি ভাবুন।
ইসতিয়াক রুপু / কবি, গীতিকার, সংবাদকর্মী। নিউইয়র্ক