মরহুম তামিম এর গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩০:৫৯,অপরাহ্ন ১৫ এপ্রিল ২০২২ | সংবাদটি ১৮৮৮ বার পঠিত
জুয়েল সাদত
জীবনে অনেক গল্প, কাহিনী লিখেছি। অনেকেরই পড়েছেন। বড় বড় পন্ডিদদের – যেমন – মেজর, ডক্টরেট, মুক্তিযোদ্বা, শিক্ষাবিদ মৃত্যুর পর অনুরোধ করে আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। সেই লেখা দিয়ে স্মারক গ্রন্থ বেরিয়েছিল। তারা সবাই সমাজ দেশের জন্য কাজ করেছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় লিখেছিলাম।
আজ শুনাব এক বিশ্য়য়কর বালকের গল্প। তামিম সৈয়দ ( ২১ বছর ১১ মাস ২৩ দিন) । শুনতে অবাক লাগছে। এইটা কেমন বয়স৷ হ্যাঁ বলছি আমার ভাতিজা তামিম সৈয়দ এর কথা। জাগতিক জীবনে সে আমার রক্তের কিছু না। তবে সে তার ও উপরে কিছু৷ আমার বন্ধু জামাল সৈয়দ এর ৫ টি সন্তানের একটি।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নের কদম রসুল গ্রামের সৈয়দ পরিবারের এক উত্তরাধিকারী ছিল তামিম। তামিমদের বাপ চাচারা আমেরিকার ফ্লোরিডায় থাকেন। আমার বাসার খুব কাছেই তামিমদের বাসা। জামাল সৈয়দ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০০১ সালে যখন আমেরিকায় আসি তখন থেকেই জামালের সাথে বন্ধুত্ব। তখন তামিমের বয়স ১ বছর৷ তামিমের বাপ ও চারজন চাচা ও কয়েকজন ফুফু সহ পুরো পরিবারের সাথে আমার গভীর বন্ধন। সেই বন্ধনটা রক্তের সম্পর্কের অনেক উপরে।
প্রসঙ্গে আসি। তানিম সৈয়দ ( ২১) গত ১১ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে ইফতারের কিছুটা আগে কিসিমির দারুল উলুম মসজিদে যাবার সময় এক মর্মান্তিক মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে করে সাথে সাথে কমা’তে ছিল। প্রায় ৪৮ টি ঘন্টা পর গতকাল ১৩ এপ্রিল বুধবার সকালে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। যে হসপিটালে সে জন্ম গ্রহণ করেছিল ওসিওয়ালা রিজিওনাল হসপিটাল সেখানেই সে ২১ বছর ১১ মাস ২৪ দিন পর মারা যায়। আগামী ২১ এপ্রিল তার ২২ তম জন্ম দিন। তার পছন্দ ক্যারট কেক। মা’ কে বলেছিল। আমি বড় হয়ে গেছি। কেক লাগবে না। আবার সে জন্মদিন পছন্দ করত না।
আজকের লেখাটা তার মৃত্যুর ঘটনা বলার জন্য না। এই চমৎকার মানবিক বালকের গুনের বর্ননা। আমাদের নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।। সে কোন সাধারন বালক ছিল না। অসম্বব ধার্মিক বলতে আমরা যা বুঝি, তার চাইতেও সে অনেক আমলের ছেলে ছিল।
মসজিদের ইমামরা তাকে এনজেল এর সাথে তুলনা করেছেন। সে আশে পাশের মসজিদের সুপরিচিত ছিল। মসজিদে ভলান্টিয়ার করত। মসজিদে সব সময় জামাতে নামাজ পড়ত। তাকে, যে যখন মসজিদে গিয়েছেন সব সময় তেলায়াত করতে দেখেছেন। গত পেন্ডানিকের সময় ১৫০ জনের ইফতারের রান্না করা হত মসজিদে। সে ত্রিশ দিন রাতের বেলা সব বড় বড় ডেগ ডেকছি ক্লিন করত। ফজর নামাজ মিস করত না। তার সাথে যারা কাজ করেছেন,সে তাদের হেল্প করত, রাইড দিত। যাদের সে রাইড দিত, বড় বাস্ক তুলতে বুড়ো মানুষদের হেল্প করত, তারা সবাই কেদেছেন আমাকে ধরে। আফসোস করছেন। সবাইকে ঋনি করে গেছে তামিম।
আরো অনেকেই আমাকে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলেছেন। তার জন্য চোখের পানি ফেলছেন। তার গুনের শেষ ছিল না। গতকাল, তাকওয়া মসজিদের ট্র্যাষ্টি আশিক চৌধুরী আমাকে বলেন, তামিম সৈয়দ কে আমি ভেবে রেখেছিলাম মসজিদের ভবিষ্যৎ কান্ডারী হবে। দুঃখ জনক আমরা তাকে হারালাম। আমাদের কমিউনিটির অনেক বড় সম্পদ ছিল তামিম
১১ এপ্রিল রাত ৮ টায় এক্সিডেন্ট হল তার বাসার কাছে, আমরা সবাই তখন তারাবীর নামাজে। ভয়ংকর সেই এক্সিডেন্ট হবার পর অনেকেই সেই রাস্তা পার হয়েছিলেন, কেউ জানতেন না, সেই এক্সিডেন্ট টা তামিমের।
বাসায় পুলিশ খবর পৌছায় রাত সাড়ে ১২ টায়। রাত ১ টার দিকে কমিউনিটির সবাই ও পরিবারের সবাই হসপিটাল যান। তারপর আরো দুই দিন রাখতে হয়। তামিম সৈয়দ ঘটনাস্থলেই ব্রেইন ডেমেজে মারাত্মক আহত হয় । একটি কারের সাথে তার মোটরসাইকেল টার সংঘর্ষ ঘটে। সে কখনও মোটরসাইকেল চালাত না। কলেজ শেষ করে ইফতার করার জন্য সে মসজিদে যাচ্ছিল।
গত দুদিন থেকে আমাদের কিসিমির তাকওয়া মসজিদে বার বার তার শারীরিক আপডেট ও দোয়া করা হচ্ছিল। দুটো মসজিদের ইমাম হসপিটালে ছুটে যান। একটা বাচ্চা ছেলে তার আমল – আকিদা দিয়ে কতটা জনপ্রিয় হতে পারে দেখে আমরা বিস্মিত। একজন নামাজি মানুষ ও মসজিদের খাদেম কতটা সুপরিচিত ছিল আমরা দেখে অবাক।
মাত্র ২২ বছরে সে চলে গেল? রেখে গেল একটা উদাহরণ। পুরো বাংলাদেশ কমিউনিটি, সিলেটি কমিউনিটি ও মুসলিম কমিউনিটি দুদিন থেকে তার বাসার সামনে ভিড় করে আছেন।
তামিম সৈয়দ ( ২২) আমেরিকায় বড় হলেও সে কোন মেয়েদের সাথে কথা বলত না। সব সময় এড়িয়ে চলত। কাজিনদের সাথেও সে দুরত্ব বজায় রাখতো। মাকে কিচেনে হেল্প করত। খুবই লো প্রোফাইলে চলাফেরা করত। পুরোনো একটা গাড়ি চালাত। কলেজ ও বাসা ও তার আত্মীয় স্বজনের বাসা। গত দুদিন থেকে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ান মসজিদ কেন্দ্রীক মুসল্লীরা তার নানা গুনের কথা বলছেন।
মওলানা পাটেল আমাদের শেখ – বারবার বলছেন, আমাদের মসজিদের জন্য অনেক বড় ডেমেজ তামিমের চলে যাওয়া। তিনি গতকাল নামাজের পর বিষদভাবে বলছিলেন তামিমের গুনের নানা কাহিনী। যত গুলো গুন থাকলে একজন জান্নাতের মানুষের ধারনা পাওয়া যায় তামিমের চলে যাবার পর সেটা দৃশ্যমান।
গত তিন থেকে তার বাসায় নানা কমিউনিটির মানুষের ঢল। রমজানের শুরুতে সে তার মাকে বলেছিল, সে ওমরাহ করতে চায়। মা বলেছিলেন, তারা সবাই যাবেন একসাথে। তাকে তিনি একা দিবেন না। সে মেনে নিয়েছিল।
অসম্ভব হাম্বল, মিতব্যয়ী, কম কথা বলা, ব্যাক বাইটিং না করা, মসজিদে হেল্প করা, মা’কে সহযোগিতা করা,মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া,তাবলিগে জড়িত থাকা, যতগুলো গুন থাকা দরকার একজন পারফেক্ট মুসলমান এর সব গুলোই তামিম সৈয়দের ছিল।
ইমাম মওলানা পাটেল ( ইমাম তাকওয়া মসজিদ) বলছিলেন, মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে একটা উছিলা, তামিমের জন্য এরকম কম সময় বরাদ্দ ছিল।
ইমাম মওলানা রশিদ ( দারুল উলুম মসজিদ) তামিম সৈ্যদ কে খুব ভাল করে জানতেন, চিনতেন। তিনি তার জন্য দোয়া করছেন ও হসপিটালে আসেন। তামিম সৈয়দ পুরো দুদিন নিস্তেজ অবস্থায় ছিল। ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার এক্সিডেন্টের পরদিন হসপিটালে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। তামিম সৈয়দ এর পরিবার এই শহরে অনেক বড়, পরদিন আমাদের হসপিটাল কতৃপক্ষ নিষেধ করে দেয় । তারপর থেকে সবাই আমরা জামালের বাসায়।
এক্সিডেন্ট কেইস, নানা আইনি জটিলতা তাই আমরা জানাজার সময় ঘোষনা করতে পারছি না। আমি নানা ওয়াটস আপ গ্রুপে পুরো কমিটিকে আপডেট জানাচ্ছি। হসপিটালের ছুটে এসেছিলেন ইবনে সিনা ইসলামিক স্কুলের প্রিন্সিপাল সিসটার রেহানা। তামিমের পরিবারকে শান্তনা দিতে ও ধৈর্য্য ধারনের আহবান জানান।
আমি সচরাচর কাঁদি না, অনেকটা কঠিন হৃদয় ধারন করি। তামিমের জন্য চোখে পানি চলে আসে।
নিজেকে ছোট মনে হয়, সে কম সময়ে অনেক বড় কাজ করে গেল। মসজিদের মুসল্লীরা যাকে সাটিফিকেট দেন, সে অনেক সৌভাগ্যেবান।
তার আরও অজানা কাহিনি হয়ত আমরা জানি না।
তামিম সৈয়দ এর আরো ৪ ভাই দুবোন। সে সহ সবাই ইবনে সিনা ইসলামিক স্কুল গ্রাজুয়েট। তার ৪ ভাই বোন সব গুলো তার মতই। তাদের অনেক গুন, ” সবর” শব্দ বলতে যে জিনিসটা তাদের সবার মধ্যে। অসম্ভব মেধাবী সব ভাইবোন।
আজ যে কোন সময় হয়ত আমরা জানাজার ঘোষনা দিব, বেশি দেরি হলে কাল শুক্রবার।
একজন পিতার জন্য ছেলেকে কবরস্থ করা কতটা বেদনার, কতটা কষ্টের আমরা জানিনা।। ভাবতে পারি না।
তামিমের জন্য দোয়া করবেনন। তামিম সৈয়দ এর দুর্ঘটনার পর থেকে আমাদের বন্ধু মোহাম্মদ চৌধুরী মুন্না, টিপু ভাই ও শহিদুল আহমেদ সব কিছু দেখাশোনা করছেন।
মরহুম তামিম সৈয়দ ( ২২) মাসুম সৈয়দ, এনাম সৈয়দ, জিল্লুর সৈয়দ ও সোয়ব সৈয়দ এর ভাতিজা ।
মরহুম তানিমের ভাই তাহের সৈয়দ, আবিদ সৈয়দ। দুই বোন সাদিয়া সৈয়দ ও সারিয়া সৈয়দ। আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।
সবাই দোয়া করবেন,রমজানের এই মাসে দোয়া কবুল হবে।
“এমন জীবন তুমি করিও গঠন
মরনের পরে যেন কাঁদে ভুবন ”
(এরকম কথা বলেছিলেন একজন কবি)
আমিন
( জুয়েল সাদত / কিসিমি)